কিভাবে একটি ভালো সিভি তৈরি করতে হয়? | জীবনবৃত্তান্ত লেখার নিয়ম

চাকরি খোঁজার সময় প্রথমেই যে কাজটি করতে হয় তা হলো ভালো সিভি তৈরি করা/ভালো জীবনবৃত্তান্ত তৈরি করা। সিভির প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। এটি আপনাকে চাকরিদাতার কাছে আকৃষ্ট ও উৎসাহিত করবে অর্থাৎ আপনার সিভি দেখেই যেন আপনাকে নির্বাচন করতে পারে।

আপনার সিভির প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে ইন্টারভিউ পর্যন্ত আপনাকে পৌঁছে দেয়া। কিছু সময় নিয়ে আপনার জিবনের প্রাপ্তিগুলো সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করে তৈরি করুন সিভি। যেখানে শুধু আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা, প্রশিক্ষণ বা অভিজ্ঞতাই নয়, এর থেকেও বেশি কিছু থাকতে হবে। নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে সর্বদাই আপনার যোগ্যতাকে এমনভাবে তুলে ধরুন যেন তা খুব সহজেই আপনার সকল তথ্যের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে।

এজন্য প্রথমেই ভালোভাবে চিন্তা-ভাবনা করুন আপনার সিভি’র কোন কোন জায়গায় আপনি জোর দেবেন। আপনাকে সিভি দিয়ে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, আপনি হাজার হাজার চাকরিপ্রার্থীর মধ্যে সম্পূর্ণ আলাদা।

সিভি তৈরি করার আগে যে সকল দিকে নজর রাখবেনঃ

১। অনেকেই আছেন অন্যের সিভি প্রায় হুবহু অনুকরণ করে নিজের সিভি তৈরি করেন। এটি একেবারেই উচিত নয়। চাকরিদাতারা সিভি দেখলেই ব্যাপারটা বুঝতে পারেন। অন্য কাউকে দিয়ে সিভি তৈরি করালেও সেটা ধরা পড়ে যায়। যে নিজে সিভি তৈরি করতে পারেন না, চাকরিদাতা কোন ভরসায় তাঁকে একটি দায়িত্বশীল পদে নিয়োগ দেবেন? তাই জীবনের প্রথম সিভি আপনার নিজেকেই তৈরি করতে হবে।

২। খুব ঝকমকে বা রঙিন কাগজে সিভি লিখবেন না। আপনার সিভিটি যেন সুশৃঙ্খল এবং চোখে পড়ার মতো হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন। যে কাগজটিতে প্রিন্ট করবেন সেটা যেন ভাল মানের সাদা বা অফ-হোয়াইট কাগজ হয় সেই দিকেও লক্ষ্য রাখবেন।

৩। বানান ভুল বা ব্যাকরণগত কোনো ত্রুটি যেন একদমই না থাকে। সিভিতে কোনো বানান ভুল বা কোনো বাক্য তৈরিতে ব্যাকরণগত ত্রুটি করে ফেলবেন না। মনে রাখবেন একটা ছোট্ট ভুলের জন্য আপনার চাকরিটা হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। তাই এইদিকে খেয়াল রাখবেন।

৪। যে ফন্টে সিভিটা লিখবেন সেটা যেন স্ট্যান্ডার্ড হয়। বিশেষ করে Times new roman font কে স্ট্যান্ডার্ড ধরা হয়ে থাকে।

৫। সিভির শিরোনামে resume, বায়োডাটা এই ধরনের কথা লিখবেন না: অনেকেই আছেন যারা সিভির ওপর Heading CV, Curriculum Vitae and Resume জাতীয় কথা লেখেন, সেটার কোনো দরকার নেই।

৬। সিভিতে সবসময় ছবি ডানদিকে স্ট্যাপ্লার পিন বা জেমস ক্লিপ দিয়ে আটকে দিবেন। ৬ মাসের বেশি পুরনো ছবি না দেয়াই ভালো। ছবিটি তোলার সময় অবশ্যই ফরমাল পোশাক পরে ছবি তুলবেন। ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড যেন খুব বেশি রঙচঙে না হয়।

৭। প্রতিটি চাকরির জন্য সিভিতে আলাদা প্রয়োজনীয় তথ্য যুক্ত করা সবচেয়ে ভালো অর্থাৎ CV সেই চাকুরীর চাহিদা অনুযায়ী তৈরী করতে হবে। যেমন, পাওয়ার প্ল্যান্টের ক্ষেত্রে সিভি তৈরি করতে গেলে অবশ্যই প্ল্যান্টের প্রতি আপনার কেমন আগ্রহ, আপনি ক্যারিয়ার হিসেবে পাওয়ার প্ল্যান্টকে কিভাবে দেখতে চান ইত্যাদি তথ্য যুক্ত করতে পারেন।

৮। ফ্রেশার বা সদ্য পাস করা চাকুরীপ্রার্থীর সিভি যেন কোনভাবেই দুই পাতার বেশি না হয় কারন চাকুরীদাতা গড়ে একটি সিভি এর উপর ৩০ সেকেন্ডের বেশী সময় দেয় না।

জীবনবৃত্তান্তের (CV) বিভিন্ন অংশ

একটি সিভিতে যে তথ্যগুলো আপনি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করবেন সেগুলো হচ্ছে–

  • শিরোনাম (Title)
  • সার সংক্ষেপ (Career Summary) –> অভিজ্ঞতা সম্পন্নদের জন্য বেশী প্রয়োজন৷
  • ক্যারিয়ার উদ্দেশ্য (Career objective)–>সদ্য পাশ করা চাকুরী প্রার্থীদের জন্য বেশী প্রয়োজন ৷
  • কাজের অভিজ্ঞতা (Experience)
  • শিক্ষাগত যোগ্যতা (Education)
  • আপনার শখ ও আগ্রহ(Hobby)
  • অতিরিক্ত তথ্য (Additional Information)
  • ব্যক্তিগত তথ্য (Personal Information)
  • রেফারেন্স (Reference)

শিরোনাম (Title):
সিভির প্রথমেই পুরো নাম লিখতে হবে। কোনোভাবেই ডাকনাম বা ছদ্মনাম লিখবেন না। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপত্রে যে নাম লেখা আছে তা-ই লিখবেন। নামের আগে মিস্টার বা মিসেস ব্যবহার করবেন না।

ঠিকানা লেখার ক্ষেত্রে চিঠিতে যোগাযোগ করা যায়, এমন ঠিকানা সংক্ষিপ্ত এবং স্পষ্ট করে লিখবেন। যোগাযোগের জন্য দিতে হবে মুঠোফোন নম্বর। আর বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে ই-মেইল ঠিকানার ক্ষেত্রে। নিজের নামের সঙ্গে মেলে এমন সংক্ষিপ্ত ই-মেইল ঠিকানা তৈরি করে সিভিতে দিবেন।

সার সংক্ষেপ ( Career Summary):
এই অংশে যে সকল ব্যক্তিদের অনেক বছরের চাকরীর অভিজ্ঞতা আছে তাদের জন্য প্রযোজ্য ৷ সর্বোচ্চ ৬-৭ লাইনে উল্লেখ করুন আপনার পূর্ব চাকরীর অভিজ্ঞতা গুলো ৷ এবং আপনার পূর্ব অভিজ্ঞতার সাফল্যগুলোও সংক্ষেপে তুলে ধরুন।

ক্যারিয়ার উদ্দেশ্য (Career objective):
এই অংশটি সদ্য পাশ করা চাকরি প্রার্থী অথবা অল্প অভিজ্ঞ চাকরি প্রার্থীদের জন্য প্রযোজ্য। আপনার চাকরিক্ষেত্রে বর্তমান উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য উল্লেখ করুন। যে প্রতিষ্ঠানে সিভিটি পাঠাচ্ছেন, আপনার যোগ্যতা তার প্রয়োজন কিভাবে মেটাতে পারে তা উপস্থাপন করুন। চাকরির জন্য উপযুক্ত ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরুন। প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনের সাথে খাপ খাইয়ে ক্যারিয়ার উদ্দেশ্য অংশটি লেখা জরুরী।

কাজের অভিজ্ঞতা (Experience):
শিক্ষার্থীদের সাধারনত সরাসরি পেশাগত অভিজ্ঞতা থাকে না। কিন্তু যে পদের চাকরির জন্য সিভিটি তৈরি করছেন, সেই সংশ্লিষ্ট কাজের কোনো অভিজ্ঞতা থাকলে তা সংযুক্ত করুন। আর যদি কাজ করে থাকেন, তবে সেই কাজের-

  • Organization name (প্রতিষ্ঠানের নাম)
  • Designation (পদবী)
  • Time period – From & To (সময়কাল)
  • Job Responsibility (দায়িত্ব)
  • Special achievement (উল্লেখযোগ্য সাফল্য):

তবে ভালো সিভি তৈরি এমন কোনো অভিজ্ঞতা উল্লেখ না করাই ভালো, যা চাকরির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

শিক্ষাগত যোগ্যতা ( Education):
এই অংশে আপনি আপনার ডিগ্রিগুলোর নাম উল্লেখ করবেন। পাশ না করলে পরীক্ষার্থী শব্দটি উল্লেখ করুন। তারপর ক্রমে একই ধারাবাহিকতায় অন্যগুলোর কথা লিখুন। এবং নিম্নেবর্নিত তথ্যগুলো প্রদান করবেন-

  • ডিগ্রির নাম। যেমন,SSC, HSC, BCom, BSC
  • কোর্স সময়কাল।
  • শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বোর্ডের নাম।
  • পরীক্ষার বছর এবং ফলাফল প্রকাশের সময়।
  • ফলাফল।

আপনার কোন ডিগ্রির ফলাফল যদি প্রকাশ না হয়ে থাকে তবে, সেই ডিগ্রির কথা উল্লেখ করার সময় অবশ্যই ব্র্যাকেটে লিখবেন। গ্র্যাজুয়েশন করার সময় কোনো রিসার্চ বা থিসিস নিয়ে কাজ করলে সেটার কথাও এই অংশে বলতে পারেন।

অতিরিক্ত তথ্য ( Additional Information):
এই অংশে আপনার অতিরিক্ত অর্জন গুলো উল্লেখ করবেন। আপনার মধ্যে পড়ালেখা বা কাজের পাশাপাশি অন্য আর কি কি গুণাবলি আছে তা উল্লেখ থাকলে ভালো হয়।

  • পদক বা সম্মাননা।
  • ভাষাগত দক্ষতা।
  • লাইসেন্স, সরকারি পরিচয়পত্র, প্রকাশিত লেখা।
  • সেচ্ছাসেবী মূলক কর্মকান্ড।

আর এ থেকে একটি মানুষের ব্যাক্তিত্ব প্রকাশ পায়।

আপনার শখ ও আগ্রহ(Hobby):
আপনার শখ বা অবসর সময়ে আপনি কি করেন তা উল্লেখ করুন।
দু-একটি আগ্রহ ও শখের কথা এই অংশে বলতে পারেন।

ব্যক্তিগত তথ্য (Personal Information):
এই অংশে আপনার বর্তমান এবং স্থায়ী ঠিকানা, ধর্ম, যদি আর কোন দেশ ভ্রমন করে থাকেন ইত্যাদি উল্লেখ করবেন।

রেফারেন্স (Reference):
সিভিতে রেফারেন্স অংশটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনার দেওয়া তথ্যগুলো সম্পর্কে যেন দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি থেকে জানা যায়, সেজন্যই এই রেফারেন্সের ব্যবস্থা। তবে যার রেফারেন্স দিচ্ছেন তাদের অনুমতি নেবেন। এবং বিষয়টি তাকে জানিয়ে রাখবেন।তাদের নাম, কোন পদে কাজ করেন, ব্যবসায়িক বা অফিসের ঠিকানা, ফোন নম্বর ইত্যাদি সঠিকভাবে উল্লেখ করবেন।

মনে রাখবেন, সিভি হচ্ছে আপনার চাকরিদাতার সামনে প্রথম উপস্থাপনা। কাজেই এর সৌন্দর্যই হচ্ছে আপনার সৌন্দর্য। সিভিতে প্রয়োজনীয় তথ্যগুলোর দেওয়া যেমন জরুরি, তেমনি এটি দেখতেও সুন্দর হওয়া জরুরি। তাই সিভি তৈরির পর প্রথম তা অভিজ্ঞতা আছে এমন কেউকে দেখিয়ে নিতে পারেন। তাহলে ভুল ত্রুটি গুলো বুঝতে সহজ হবে। ভালো সিভি তৈরি করার ক্ষেত্রে অযথা বাড়তি কিছু লিখে আর ডিজাইন করে সিভিকে ভারি করবেন না। তাহলে সহজে এটি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবে।