টাইটেলটি দেখে অনেকেই নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছেন? আসলেই কি সূর্যের কাছ থেকে ছবি তুলা সম্ভব? এমন অসম্ভবকেই সম্ভব করেছে নাসা।
সূর্য থেকে ৩৯ লক্ষ মাইল দূর থেকে সূর্যের ঝড়-ঝঞ্ঝা দেখল নাসা। সূর্য থেকে পৃথিবী সহ অন্যান্য গ্রহের দিকে ছুটে আসা সৌরবায়ু হঠাৎ ফিরে যায় সূর্যের দিকে। তারপর ইলেকট্রন, প্রোটনের মতো খুব ছোট ছোট কণাদের নিয়ে আসে এবং গ্রহের দিকে ছুটে যায়। এই ঘটনাটি ঘটে সৌরমণ্ডলের মধ্যেই।
উল্লেখ্য, এই অবাক করা কাণ্ডকারখানা আবার সর্বক্ষেত্রে সমান নয়। কোথাও বেশি তো কোথাও কম। সৌর বায়ুকে দেখে মনে হবে কোন কাজে রওনা দিয়ে ফেলেছে কিন্তু খুব দরকারি জিনিস নিতে ভূলে গেছে। তড়িঘড়ি ফিরে গিয়ে তা নিয়ে এসে পুনরায় গ্রহদের দিকে যাত্রা শুরু করছে।
বিজ্ঞানীরা এটিকে সৌরবায়ু ‘মতিভ্রম’ বলে ব্যাখ্যা করছেন। এর গতিবেগ প্রায় সেকেন্ডে ৯০০ থেকে ১০০০ কিলোমিটার। তাপমাত্রা থাকছে ১০ লক্ষ ডিগ্রি কেলভিন। এতদিন বিজ্ঞানীরা মনে করতেন সৌরবায়ুর অভিমুখ একই দিকে, কিন্তু সেই তথ্য ভুল প্রমাণিত করল পার্কার সোলার প্রোব।
“পার্কার সোলার প্রোব” কি?
পার্কার সোলার প্রোব হল প্রথম মহাকাশযান যা সৌর করোনায় পরিভ্রমণে সক্ষম। অনেকে করোনা নামটি দেখে করোনা ভাইরাসের কথা মাথাতে আসাটাই স্বাভাবিক। এই করোনা কোন ভাইরাস নয়, এটি সূর্যের নিকটবর্তী একটি সারফেস যেখানে তাপমাত্রা থাকে লক্ষ ডিগ্রী সেলসিয়াস। সূর্যের করোনাল প্লাজমা এবং চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের কাঠামো এবং গতিবিদ্যা সৌর করোনাকে উত্তাপিত করে এবং সৌর বায়ুকে উদ্দীপিত করে শক্তিশালী কণাকে ত্বরান্বিত করে।
সোলার পার্কার প্রোব এরুপ নামকরণের কারণ
জ্যোতির্বিজ্ঞানী ইউজিন নিউম্যান পার্কার যিনি “সৌর বায়ু” শব্দটি তৈরি করেছিলেন তার সম্মানে মহাকাশযানটির নাম “পার্কার সোলার প্রোব” এভাবে নামকরণ করা হয়েছিল।
গঠন
- এটির একটি সাদা অ্যালুমিনা পৃষ্ঠ তাপমাত্রা শোষণকে হ্রাস করে।
- এটির সাদা সিরামিক কোটিং, কার্বন ফোম, ব্যারিয়ার কোটিং, হিট সিল্ড থাকে।
- মহাকাশযান সিস্টেম এবং shield ছায়ার কেন্দ্রীয় অংশে অবস্থিত, যেখানে সূর্য থেকে সরাসরি বিকিরণ পুরোপুরি অবরুদ্ধ। যদি shied মহাকাশযান এবং সূর্যের মধ্যে না থাকে তবে তদন্তটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে।
- যেহেতু পৃথিবীর সাথে রেডিও যোগাযোগ প্রতিটি দিকে প্রায় আট মিনিট সময় নেবে, পার্কার সোলার প্রোবকে দ্রুত কাজ করতে হবে।
- এটি চারটি আলোক সেন্সর ব্যবহার করে।
- এটাতে সেকেন্ডারি সৌর প্যানেল এবং যন্ত্রের অপারেটিং তাপমাত্রা বজায় রাখতে পাম্প ফুয়েলড কুলিং ব্যবহার করা হয়েছে।
- তাপীয় সুরক্ষা ব্যবস্থায় চাহিদা কমিয়ে আনার এটির উচ্চতর পেরিওহিলিয়নও রয়েছে।
ইতিহাস
পার্কার সোলার প্রোব ধারণাটি ১৯৫৮ সালের ফিল্ডস অ্যান্ড পার্টিকেলস গ্রুপের জাতীয় রিপোর্ট থেকে উদ্ভব ঘটে যেখানে “সোলার প্রোব” এর অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য একাধিক মহাকাশ মিশনের প্রস্তাব করেছিল।
বুধের কক্ষপথ এবং সূর্যের আশেপাশের কণা এবং ক্ষেত্রগুলি অধ্যয়ন করার জন্য ৭০ এবং ৮০ এর দশকে নাসা ব্যাপারটির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে তবে ব্যয়ের কারণে এটি সর্বদাই পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
১৯৯০-এর দশকে অল্প ব্যয়ে সোলার প্রোব মিশন প্রোগ্রাম এর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। প্রোগ্রামটির প্রথম তিনটি মিশন হল : Solar Orbit, Pluto, Kuiper belt পুনরুদ্ধার মিশন।
আসল সোলার প্রোব ডিজাইনে একটি মেরু কক্ষপথে প্রবেশের জন্য বৃহস্পতির কাছ থেকে একটি মাধ্যাকর্ষণ সহায়তা ব্যবহৃত হয়েছিল যা প্রায় সরাসরি সূর্যের দিকে নেমে আসে। যদিও এটি গুরুত্বপূর্ণ সৌর মেরুগুলি অন্বেষণ করেছিল এবং পৃষ্ঠের আরও কাছাকাছি এসেছিল।
এই ব্যয়বহুল মিশনের জন্য সৌর বিকিরণের চূড়ান্ত তারতম্য এবং বিদ্যুতের জন্য একটি রেডিওসোটোপ তাপ জেনারেটর প্রয়োজন ছিল।
শান ও কিফিকে নাসার প্রশাসক হিসেবে নিয়োগের পরে, ২০০৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারাল বাজেটের জন্য রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশের অনুরোধে প্রোগ্রাম বাতিল করা হয়েছিল।
অবশেষে সূর্যকে ছুঁয়ে দেখার পরিকল্পনা নিয়ে ২০১৮ সালে ১২ অগস্ট সৌর অভিযানে রওনা দেয় নাসার মহাকাশযান ‘পার্কার সোলার প্রোব’।
সূর্যের আশেপাশে যাওয়ার কথা ভাবতেও কেউ পারেননি এতদিন। কারণ শুধুমাত্র সূর্যের তাপমাত্রা। যা মুহুর্তের মধ্যে সবকিছু গলিয়ে দিতে পারে। কিন্তু এবার সেই অসম্ভবকেও জয় করেছে আমেরিকার মহাকাশ সংস্থা নাসা। তারা জানিয়েছে, সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে সৌরবায়ু। ঘুরতে ঘুরতেই সূর্যের কক্ষপথ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসছে গ্রহ ও উপগ্রহের দিকে।
পার্কার সোলার প্রোব জানিয়েছে, সূর্যের কাছে অনেকটা এলাকা জুড়ে কোনো ধুলোবালি নেই। বিজ্ঞানীরা যাকে ‘ডাস্ট-ফ্রি জোন’ বলে মনে করছেন।
কেন নেই ধুলিকণা?
বিজ্ঞানীরা মনে করছেন সূর্যের তাপ এতটাই যে এই এলাকায় নেই কোনো মহাজাগতিক ধূলিকণা।
অবিশ্বাস্য তথ্য
- এত দ্রুতগতির কোনো কিছু আগে তৈরি হয়নি। সূর্যের চারদিকে এটি প্রতি ঘণ্টায় ৬৯০,০০০ কিমি পর্যন্ত গতিতে ঘুরবে। অর্থাৎ এই গতিতে নিউইয়র্ক থেকে টোকিও যেতে লাগবে এক মিনিটেরও কম সময়।
- ৬০ লাখ কিলোমিটার দূর থেকে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে তথ্য সংগ্রহ করতে থাকবে।
- এই প্রকল্পের অন্যতম বিজ্ঞানী ড. নিকি ফক্স বলেছেন, “আমি বুঝতে পারছি ৬০ লাখ কিমি দূরত্বকে কখনই নিকট দূরত্ব বলে মনে হবেনা, কিন্তু যদি ধরে নেয়া হয় ভূপৃষ্ঠ এবং সূর্যের দূরত্ব এক মিটার, তাহলে প্রোব সূর্য থেকে মাত্র ৪ সেমি দূরে থাকবে।”
বিজ্ঞান নিয়ে আরো মজার পোস্ট