পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম ফাস্টট্র্যাক প্রজেক্ট। বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সাল নাগাদ ৩০০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়েছে, তার মধ্যে ২০০০০ মেগাওয়াট কয়লার মাধ্যমে উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তারই ফলশ্রুতিতে মাতারবাড়ি, রামপাল, পায়রা তাপবিদ্যুত কেন্দ্র তৈরি হচ্ছে খুব দ্রুততার সাথে।
প্রায় ১০০২ একর জমির উপর স্থাপিত হচ্ছে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ২ টি ইউনিট।
মোট ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের ক্ষমতা নিয়ে দেশের অন্যতম বড় পাওয়ার প্ল্যান্ট হতে যাচ্ছে এটি। এটি বাস্তবায়িত হলে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের বিদ্যুৎের চাহিদা বেশ ভালোভাবেই মিটবে।
লোড শেডিং থেকে চিরতরে মুক্তি মিলবে এলাকার মানুষের, দেশের অর্থনীতির চাকা সচল হবে এবং পদ্মা ব্রিজ বাস্তবায়নের ফলে যে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাবে, সেটির সিংহভাগ এই অঞ্চলের পাওয়ার হাব থেকে মেটানো সম্ভব হবে।
চীন ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগের ফলাফল এটি, পটুয়াখালীর কলাপাড়ার ধানখালীর ইউনিয়নের নিশানবাড়িয়া এলাকায় এটি স্থাপিত হচ্ছে। এতে বাংলাদেশ ও চীনের সমান মালিকানা থাকছে, বাংলাদেশের পক্ষে নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড(NWPGCL) ও চীনের পক্ষে চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইম্পোর্ট & এক্সপোর্ট কর্পোরেশন(CMC), তাদের যৌথ উদ্যোগে গঠিত বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড এই পাওয়ার প্ল্যান্টের প্রকৃত মালিক।
চীনের এক্সিম ব্যাংকের ঋনে এই প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
কিভাবে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র কাজ করে দেখতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
বড়পুকুরিয়া ও রামপাল এর পরে কয়লা চালিত ৩য় বিদ্যুতকেন্দ্র হিসেবে আত্নপ্রকাশ করতে যাচ্ছে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র।
বর্তমানে প্রথম ইউনিটের কাজ শেষ এবং এর ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুত লাইনে সংযোগ করা হয়েছে এই বছরের শুরুতে, পর্যায়ক্রমে সর্বোচ্চ ক্ষমতায় উন্নীত করা হবে।
সেজন্যে ৪০০ কেভির ১৬২ কিলোমিটার ডাবল সার্কিট হাইভোল্টেজ লাইনের কাজ শেষ করেছে পিজিসিবি, ফলে সহজেই এই প্ল্যান্ট থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ পটুয়াখালীর কলাপাড়া হয়ে গোপালগঞ্জের মকসুদপুরের ৪০০কেভি/২৩০কেভি সাবস্টেশনে যুক্ত করার মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হবে।
এই প্রজেক্টের জন্যে প্রায় ১২০ টি গাছপালা সহঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, যাদের জন্যে পূর্নবাসন প্রক্রিয়া চলমান।
ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া থেকে কয়লা এনে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা করা হবে।
এক নজরে এর কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক:
কাজ শুরু: ২০১৫ সালের মার্চে
কোম্পানি: BCPCL
মোট ব্যবহৃত এরিয়া : ৯৮২.৭৭ একর
মোট ব্যয়: ২.৪৮বিলিয়ন ডলার বা ২১ হাজার কোটি টাকা
ইউনিট: ২টি
মোট ক্ষমতা: ২*৬৬০= ১৩২০ মেগাওয়াট
প্ল্যান্টের ধরণ: আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল
বার্ষিক কয়লা চাহিদা: ৪২-৪৬লক্ষ মেট্টিক টন
দিনপ্রতি কয়লা লাগবে: ১৩ হাজার মেট্রিক টন(for 2 unit)
যে যে দেশ থেকে কয়লা আমদানি করা হবে: ইন্দোনেশিয়া(৫০%)+অস্ট্রেলিয়া (৫০%)
কয়লার গ্রেড: বিটুমিনাস/সাব বিটুমিনাস
কয়লার ক্যালরিফিক ভ্যালু: ৪৭০০-৫৫০০কিলোক্যালরি/কেজি
কয়লায় সালফারের পরিমাণ: ০.৪৭%
লাইফটাইম: ২৫ বছর
থার্মাল ইফিসিয়েন্সি: ৪৪.৪৯%
বয়লার টাইপ: কোল ফায়ার্ড বাষ্প চালিত ডিসি বয়লার
জেনারেটর রেটিং: ৬৬৭ এমভিএ
রেটেড জেনারেটিং ভোল্টেজ: ২০কেভি
কয়লা মজুদ রাখতে হবে: ৪০-৬০দিনের
চিমনীর উচ্চতা:২৭৫মিটার
পানি লাগবে: ৪৪২৪.৩ মি^৩/ঘন্টা
SOX এমিশন: ৮২৭গ্রাম/সেকেন্ড
NOX এমিশন: ৬৩০.৮গ্রাম/সেকেন্ড
মোট শ্রমিক: ৯০০০ জন
পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্য মোট স্টাফ: ২৪০ জন
পানি নেওয়া হবে : আন্ধারমানিক নদী থেকে
পার ইউনিট কস্ট: ৬ টাকা ৫০ পয়সা(পার টন কয়লা ১১০ডলার করে)
চ্যানেলের নাম: রাবনাবাদ চ্যানেল, ২৪ কিমি পথ অতিক্রম করে জাহাজ এই কেন্দ্রে আসে কয়লা নিয়ে।
কোল ইয়ার্ড: ৩টি,ক্যাপাসিটি- ৫৪*১০৪টন
প্রথম ইউনিট উৎপাদনে: ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে
দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদনে : ২০২০ সালের জুনে
সাব ও আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল পাওয়ার প্ল্যান্টের মধ্যে পার্থক্য এখানে দেখে নিনঃ
আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি বর্তমানে সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তি এই কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রেক্ষাপটে। এছাড়াও এই ফেজ ১ এর ১৩২০ মেগাওয়াট এর পাশাপাশি আরো একটি ফেজ ২ এর আওতায় ১৩২০ মেগাওয়াট এর আরো একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সমীক্ষার কাজ শেষ হয়েছে এবং এর জন্যে জায়গাও এখানে বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
পায়রা পাওয়ার হাব:
প্রায় ৯৬,০০০ কোটি টাকা ব্যয়ে মোট ৯,০০০মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে যার মধ্যে NWPGCL করবে ৬,২৪০ মেগাওয়াট, NWPGCL+CMC মিলে ১,৩২০মেগাওয়াট, সিমেন্স করবে ৩,৬০০ মেগাওয়াট এলএনজি ভিত্তিক পাওয়ার প্ল্যান্ট, এবং RCPL ও আশুগঞ্জ প্রত্যেকে একটি করে ১,৩২০ক্ষমতার পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করবে। সেই সাথে ১০০ মেগাওয়াট সৌর ও ৫০ মেগাওয়াট বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে।
যেভাবে কয়লা আমদানি করা হবেঃ
কালিমান্তান পোর্ট অফ ইন্দোনেশিয়া>প্ল্যান্ট সাইটের লাইটারেজ জাহাজের অ্যাংকর পয়েন্ট>সেখান থেকে বার্জে>সেখান থেকে কয়লা আনলোডিং পয়েন্ট। সম্পূর্ন দূরত্ব পানিপথে অতিক্রম করতে হবে।
ধারণা অনুযায়ী ইন্দোনেশিয়ার কালিমান্তান পোর্ট থেকে বাংলাদেশের পায়রা পাওয়ার প্ল্যান্ট পর্যন্ত দূরত্ব ৪৯০০ কিমি, সে হিসেবে কয়লা আসতে সময় লাগে ২৭ দিন।
গৃহীত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাঃ
পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপন্ন সালফারকে ডিসালফারাইজেশন করার জন্য চুনাপাথর ব্যবহার করা হবে, সে হিসেবে দুই ইউনিটের জন্য দিনপ্রতি ১৪৪টন চুনাপাথর লাগবে। প্ল্যান্ট থেকে স০২ নির্গত হবে ৮২৭গ্রাম, এফজিডি প্লান্ট ইন্সটল থাকার কারণে মাত্র ৮২.৭গ্রাম স০২ প্রতি সেকেন্ডে বায়ুমন্ডলে মিশবে। ৯০% স০২ এফজিডি প্ল্যান্ট শোষণ করে নিবে(একটি ইউনিটের জন্যে)।
চুল্লির মুখ থেকে ১৩৩মিলিগ্রাম/মিটার^৩ এর কম স০২ নির্গত হবে যা বিশ্বব্যাংক প্রদত্ত ২০০-৮৫০মিলিগ্রাম/মিটার^৩ থেকে অনেক কম,ডাস্ট রিমুভাল মাত্রা ৯৯.৫% হওয়ার ফলে মাত্র ৪০ মিলিগ্রাম/মিটার^৩ চেয়েও কম ডাস্ট বায়ুমন্ডলে মিশবে, যার নিরাপদ মাত্রা ধরা আছে ৫০ মিলিগ্রাম/মিটার^৩। এছাড়াও নক্স এর মাত্রাও নিরাপদ মাত্রার অনুকূলেই থাকবে, লিমিট যেখানে ৫১০ মিলিগ্রাম/মিটার^৩, সেখানে পায়রা তাপবিদ্যুত কেন্দ্র থেকে নির্গত হবে ৩৫০ মিলিগ্রাম/মিটার^৩ এর চেয়েও কম, ফলে বলাই যায় অনেকটাই ক্লিন উপায়েই এই আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল পাওয়ার প্ল্যান্টে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে।
কুলিং ওয়াটার সম্পর্কেঃ
পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এর দুই ইউনিটের জন্যে আন্ধারমানিক নদী থেকে ঘন্টায় ১,৪৭,৯১৭ ঘনমিটার পানি উত্তোলন করা হবে। সমীক্ষায় দেখা গেছে যে , শুষ্ক মৌসুমে প্রতি সেকেন্ডে রাবনাবাদ চ্যানেল দিয়ে ৪০,০০০-৪৪,০০০ ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়, যা দ্বারা প্ল্যাণ্টের পানির চাহিদা খুব সহজেই মেটানো যাবে। তাই পানি সংক্রান্ত চিন্তা নেই।
আশেপাশের সংশ্লিষ্ট এলাকা থেকে প্ল্যান্টের দূরত্বঃ
কলাপাড়া উপজেলা শহর থেকে ১৩কিমি দূরে।
কাজল নদীর তীরে অবস্থিত পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি
সুন্দরবন থেকে ৬৫ কিমি দূরে অবস্থিত পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র।
বরিশাল এয়ারপোর্টঃ ১১০ কিমি দূরে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরঃ ২০০ নটিক্যাল মাইল দূরে
বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুত কিনে তার অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এর মাধ্যমে গ্রাহকদের মাঝে পৌছায় দিবে।