একটি কথা প্রচলিত আছে, ভালোর সাথে ভালো আর খারাপের সাথে খারাপ। বিদ্যুৎ মহাশয় কিন্তু এই নীতিতেই চলে। এই মহাশয় মানুষের কল্যাণে নিজকে বিলিয়ে দিচ্ছেন অকাতরে, কিন্তু এই মহাশয়কে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে তিনি হতে পারেন বড় ট্র্যাজেডির কারণ।
চিড়িয়াখানা এবং সুইচগিয়ার সিস্টেম
মনে করুন, আপনি মিরপুর চিড়িয়াখানায় বেড়াতে গেলেন। গিয়ে দেখলেন সবাই সিংহের খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে চিত্তবিনোদন করছে। আপনিও সাথে সাথে ভয়ঙ্কর সব প্রানীদের কাছাকাছি এসে আনন্দ উপভোগ করে যাচ্ছেন। একবার ভাবুন তো, এই প্রাণীগুলো যদি চিড়িয়াখানার খাচায় বন্দি না হয়ে মুক্ত থাকতো, তাহলে আপনিসহ সব পরিদর্শনকারীর কি অবস্থা হতো?
প্রাণীগুলো খাচায় বন্দি, তাই নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেয়েছেন বলেই আপনি আনন্দ করে যাচ্ছেন। বিদ্যুৎ শক্তিকেও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কিছু কন্ট্রোলিং এবং প্রটেক্টিভ ডিভাইস রয়েছে। যা আপনাকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিচ্ছে। আর এজন্যই বিদ্যুতের সার্কিট দ্বারা বেষ্টিত গৃহে নিশ্চিন্তে রাতে নাক ডেকে ঘুমাতে পারছেন।
সুইচগিয়ার প্রটেকশন সিস্টেম
পাওয়ার সিস্টেমে কন্ট্রোলিং এবং প্রটেক্টিভ ডিভাইসের গুরুত্ব অপরিসীম। এই বিষয়গুলোকে নিয়েই “সুইচগিয়ার এন্ড প্রটেকশন” শব্দগুলোর জন্ম। সমগ্র পাওয়ার সিস্টেমকে নিয়ন্ত্রনের জন্য ধাপে ধাপে পরিকল্পিতভাবে কন্ট্রোলিং এবং প্রটেক্টিভ ডিভাইসকে সংযুক্ত করা হয়েছে। সার্কিট ব্রেকার,সার্জ এরেস্টার, লাইটনিং এরেস্টার, অটো-রিক্লোজার, ফিউজ, রিলে, আইসোলেটর, এলার্ম সার্কিট উইথ রিলে, বিভিন্ন ধরনের সুইচ। এরাই আপনাকে আনন্দচিত্তে বিদ্যুৎ ব্যবহারে নিরাপত্তা এবং নিয়ন্ত্রণের নিশ্চয়তা দেয়।সুতরাং এদের কেউ কেউ আপনার গৃহে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছে। শুধু আপনার গৃহে নয়। এরা উৎপাদন ব্যবস্থা, পরিবহন ব্যবস্থা, বিতরন ব্যবস্থা তথা সমগ্র পাওয়ার সিস্টেমেই প্রয়োজনীয় স্থানে সজ্জিত। প্রটেক্টিভ ডিভাইসগুলো নিরাপত্তায় নিয়জিত প্রহরী। আর কন্ট্রোলিং ডিভাইসগুলো হুকুমের গোলাম।
কন্ট্রোলিং ডিভাইস দ্বারা আপনি কোন লাইনকে অন বা অফ করতে পারবেন আর প্রটেক্টিভ ডিভাইসগুলো লাইনে কোন ত্রুটি (ওভার লোড, শর্ট সার্কিট ইত্যাদি) হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে লাইনকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। অর্থাৎ ত্রুটি দেখা দিলে লাইনকে অটোমেটিক্যালি বন্ধ করে দেয় সার্কিট ব্রেকার। রিলে এই কাজে সার্কিট ব্রেকারকে সহায়তা করে থাকে। ত্রুটি হয়েছে তা সনাক্ত করার দায়িত্ব রিলের। ত্রুটি সনাক্ত করার সাথে সাথেই রিলে সার্কিট ব্রেকারকে নির্দেশ দেয় সরবারাহ বা লাইন বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। রিলের সাথে কখনো, কখনো দেখে থাকবেন এলার্ম সার্কিট যুক্ত। ত্রুটি দেখা দিলে এলার্ম সার্কিটকে জাগ্রত করে দেয় এই রিলে।
বিদ্যুৎ ব্যবস্থার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করে প্রটেক্টিভ ডিভাইসগুলো, ত্রুটিযুক্ত অংশকে ভাল অংশের সার্কিট হতে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। অনেকটা টিউমার অপসারনের মত। বজ্রপাতের কারনে উৎপন্ন সার্জ ভোল্টেজ থেকে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার দামী ইকুইপমেন্টগুলোকে রক্ষা করে লাইটনিং এরেস্টার। ট্রান্সফরমারকে ত্রুটির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ব্যবহার করা হয় বুখলজ রিলে। ডিস্ট্রিবিশন ট্রান্সফরমারকে রক্ষা করার জন্য ব্যবহার হয় ড্রপ আউট ফিউজ। উচ্চ ভোল্টেজ লাইনকে পর্যবেক্ষন করতে সহায়তা করে instrument transformer (CT এবং PT) আর তাদের আরেক সাথী হল অটো-রিক্লোজার। এই অটো-রিক্লোজারের কারণে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ফিরে আসে। অটো-রিক্লোজারের কথা আমি চাইলে সরাসরিও বলতে পারতাম। কিন্তু এত প্রারম্ভিকার মূল উদ্দেশ্য ছিল আমাদের আশেপাশের সমগ্র সুইচগিয়ার সিস্টেমকে একটু স্মরণে নিয়ে আসা। তাহলে বিষয়টিকে ভালভাবে উপলব্ধি করতে সুবিধা হবে।
অটো-রিক্লোজার কেন ব্যবহার করা হয়?
বিদ্যুৎ সরবরাহ ও বিতরন ব্যবস্থায় ওভারহেড ট্রান্সমিশন লাইনে অধিকাংশ ত্রুটি ট্রানজিয়েন্ট টাইপের।
ট্রানজিয়েন্ট ফল্ট কি?
পাওয়ার সিস্টেমে যেসমস্ত ত্রুটি খুব অল্প সময়ের জন্য সংঘটিত হয় সেসমস্ত ফল্টকে বলা হয় ট্রানজিয়েন্ট ফল্ট।
মনে করুন, আগামীকাল আপনার এক্সাম আছে। পড়ার টেবিলে বেশ মনযোগ দিয়ে পড়ছেন। বাইরে ঝড়ো হাওয়া বইছে। আকস্মিকভাবে বজ্রপাত হল এবং বিদ্যুৎ চলে গেল। চলে যাওয়ার খুব অল্প সময়ের মধ্যে আবার চলেও এল। আসলে এখানে কি ঘটেছে? সাধারণত বজ্রপাত, পাখি, গাছের শাখা-প্রশাখা ইত্যাদির মাধ্যমে সাময়িকভাবে লাইন পতন কয়েক মুহূর্ত পরে আপনা-আপনি সেরে যায়।
কেননা, ট্রানজিয়েন্ট টাইপের ফল্টগুলো খুব তাড়াতাড়ি দূরীভূত হয়ে যায়। এক্ষেত্রে সাধারণ সার্কিট ব্রেকারে ত্রুটি দেখা দেওয়া মাত্রই ট্রিপ করে যায় এবং পরবর্তী মুহূর্তে ত্রুটি আপনা-আপনি সেরে গেলেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনঃসংযোগ হয় না এবং এক্ষেত্রে পুনঃসংযোগের জন্য ব্যক্তি বিশেষের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয় না। উল্লেখিত অসুবিধা দূরীকরনের জন্য অটো-রিক্লোজার ব্যবহারের মাধ্যমে নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহের নিশ্চয়তা বিধান করা হয়। এতে সার্কিটের ডাই-ইলেকট্রিক শক্তি বৃদ্ধি পায়।
অটো-রিক্লোজারের কার্যপ্রণালী
অটো রিক্লোজার হল উপস্থিতবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যাক্তির মত যারা অল্প সময়ের মধ্যেই কোন সমস্যার সমাধান খুব সহজেই করে ফেলতে পারে। কিন্তু ব্যক্তিটি যদি বার বার চেষ্টার পরেও সমস্যার সমাধান করতে না পারে তাহলে এক পর্যায়ে হাল ছেড়ে দিবে। তেমনিভাবে অটো রিক্লোজার ত্রুটি দেখা দিলে কিছু সময়ের ব্যবধানে (সাধারনত 0.3 সেকেন্ড) লাইনকে বিচ্ছিন্ন এবং পুনঃসংযোগ করতে পারে। পর পর তিনবার এ প্রচেষ্টা চালানোর পরও ত্রুটি স্থায়ী হলে এটি লাইনকে আর পুনঃসংযোগ করে না যেমনটি উপস্থিত বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিটি হাল ছেড়ে দিয়েছিল। তখন ধারনা করা হয় বড় ধরনের ত্রুটি দেখা দিয়েছে এবং সেক্ষেত্রে ত্রুটি নির্ধারন করে মেরামতের প্রয়োজন। এমতাবস্থায় ব্যক্তিবিশেষের উপস্থিতির মাধ্যমে ত্রুটি সেরে সার্কিট ব্রেকার চালু করতে হয়। এখানে উল্লেখ্য যে এই প্রসেসে সময় এত কম লাগে যে, তা সাধারন গ্রাহকদের দৃষ্টিগোচর হয় না। প্রধানত গ্রামীন সরবরাহ বা এল. টি লাইনে ইহা বেশি ব্যবহৃত হয়। সাধারণত দুই ধরনের রিক্লোজিং ব্যবস্থা ব্যবহৃত হয়ে থাকে, যথাঃ সিঙ্গেল ফেজ অটো-রিক্লোজিং এবং থ্রি-ফেজ অটো-রিক্লোজিং।
সুইচগিয়ার নিয়ে আরো কিছু পোস্ট
সুইচগিয়ারের বিভিন্ন উপাদান, বৈশিষ্ট্য, সিস্টেমের ফল্ট সম্বন্ধে আলোচনা
সার্কিট ব্রেকারের ব্রেকিং ক্যাপাসিটি এবং ভ্যাকুয়াম সার্কিট ব্রেকার
পাওয়ার গ্রীডের অতন্দ্র প্রহরী SF6 সার্কিট ব্রেকার নিয়ে আলোচনা