আমাদের সকলেরই বলবিদ্যা নামক মজাদার বিষয়টির উচ্চ মাধ্যমিক/ডিপ্লোমা পর্যায় থেকেই অভিজ্ঞতা রয়েছে। বলের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত সকল মজাদার টপিক রয়েছে পদার্থবিজ্ঞানের এই শাখায়। তবে টপিকগুলোর মূল বিষয়বস্তু উপলব্ধি করতে না পারলে এগুলো নীরস বলেই মনে হবে। আজ বলবিদ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ টপিক লামির উপপাদ্য নিয়ে আপনাদের সামনে উপস্থিত হলাম। চলুন বাস্তব কিছু ঘটনার নিরিখে এই টপিক নিয়ে আড্ডা জমানো যাক।
লামির উপপাদ্যের বিবৃতি
যদি তিনটি বল সাম্যাবস্থায় থাকে তাহলে যেকোন একটি বল এবং অপর দুটি বলের অন্তভূর্ক্ত কোণের সাইনের অনুপাত সর্বদা ধ্রুব সংখ্যা হবে। তার মানে কি দাঁড়াল? যদি তিনটি বল A, B, C হয় এবং A এবং B এর মধ্যবর্তী কোণ γ , B এবং C এর মধ্যবর্তী কোণ α, P এবং R এর মধ্যবর্তী কোণ β । তাহলে লামির উপপাদ্য অনুসারে দাঁড়ায়,
A/sinα = B/sinβ = C/sinγ
কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, বলের সাম্যাবস্থা বলতে কি বোঝায়? কখন তিনটি বল সাম্যবস্থায় থাকে? চলুন কিছু বাস্তব উদাহরণের নিরিখে এই বিষয়টি আলোচনা করে নেয়া যাক।
বলের সাম্যাবস্থা বলতে কি বোঝায়?
মনে করুন, আপনার বিদ্যালয়ে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চলছে। দড়ি টানাটানি খেলা চলছে। আপনি দড়ি খেলা উপভোগ করছেন। দড়ি খেলায় দুটি গ্রুপ অংশ নিল যারা উভয়পাশ থেকে দড়ি টানবে। আপনি দর্শক হিসেবে দড়ি খেলা উপভোগ করছেন। আপনি হঠাৎ করে খেয়াল করলেন, দড়িটি কোন দিকেই মুভ করছেনা যেন একটা পয়েন্টেই স্থির হয়ে আছে। অথচ দুই গ্রুপই উভয় পাশ থেকে দড়িটিকে টানার চেষ্টা করছে। এখানে মূলত হচ্ছেটা কি? বস্তুত এটাই হল সাম্যবস্থা। কারণ এখানে উভয়পাশের বলের লব্ধি শূণ্য। কারণ উভয় গ্রুপ সমান ও বিপরীতমুখী বল প্রয়োগ করছে।
ব্যাপারটিকে একটু গাণিতিকভাবে বিশ্লেষণ করা যাক। ধরলাম গ্রুপ ১ এর বল P, গ্রুপ ২ এর বল Q। এখন দুই গ্রুপের দুটি বলের মধ্যবর্তী কোণ 180°। এখন বলের লব্ধির সূত্রানুসারে পাই,
লব্ধি R = √(P2+Q2+2PQcosθ)
= √(P2+Q2+2PQcos180°)
= √(P2+Q2-2PQ)
=√(P-Q)2
=P-Q
যেহেতু উভয় পাশের বল সমান সেহেতু P = Q
তাহলে লব্ধি দাঁড়ায় = P-P = 0
একারণেই মূলত দড়িটিকে স্থির দেখাচ্ছিল। দুই এর অধিক বলের ক্ষেত্রেও সাম্যবস্থা তৈরি হতে পারে। তবে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল লামির উপপাদ্য শুধুমাত্র তিনটি বলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
লামির উপপাদ্যের শর্ত
লামির উপপাদ্য সবক্ষেত্রে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। এর জন্য কিছু শর্ত রয়েছে। যেমনঃ
- লামির উপপাদ্য প্রয়োগ করার জন্য সিস্টেমে তিনটি ফোর্স থাকতে হবে।
- বলগুলো একই সমতলে ক্রিয়াশীল হতে হবে।
- বলগুলো অসমান এবং অসমান্তরাল হতে হবে
- বলগুলোর মধ্যবর্তী কোণ ১৮০° এর বেশি হওয়া যাবেনা।
- তিনটি বল সাম্যবস্থায় থাকতে হবে।
এই সমস্ত শর্তগুলো পূরণ হলেই লামির উপপাদ্য প্রয়োগ করা যাবে।
লামির উপপাদ্যের ব্যবহারিক ক্ষেত্র কোথায়?
বলবিদ্যা আমাদের বাস্তবজীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বৈজ্ঞানিক এবং প্রকৌশল সেক্টরে বলবিদ্যার ভূমিকা অনস্বীকার্য। আর লামির উপপাদ্য ও তার ব্যতিক্রম নয়। লামির উপপাদ্যের ব্যবহারিক ক্ষেত্রগুলো উল্লেখ করা হলঃ
ফোর্সবোর্ড
আমরা অনেকেই ফিজিক্স বা মেকানিক্সের ব্যবহারিক ক্লাসে ফোর্সবোর্ড ব্যবহার করেছি। ফোর্সবোর্ডে অনেকগুলো বস্তু ঝুলিয়ে বোর্ডে এক্টিং ফোর্স, ফোর্সের লব্ধি, লব্ধির দিক সহজেই বের করা সম্ভব। একইভাবে তিনটি বল ফোর্সবোর্ডে ব্যবহার করে লামির উপপাদ্য প্রয়োগ করা সম্ভব।
মেক্সানিক্স রিসার্চ
বলবিদ্যা সংক্রান্ত বিভিন্ন ফর্মূলা নিয়ে রিসার্চ এর জন্য লামির উপপাদ্য খুবই কার্যকরী। এছাড়াও থ্রি ডি মেকানিক্স লামির উপপাদ্য বেশ কার্যকরী।
এয়ারস্পেস এবং মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং
এয়ারস্পেস এবং মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং ফিল্ডে লামির থিওরেম বেশ কার্যকরী। এয়ারক্রাফটের মাল্টি মুভমেন্ট, টর্ক, এংগেল হিসেবের ক্ষেত্রে লামির উপপাদ্য বেশ কার্যকর।
মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং এ শিপের ড্রাইভিং ফোর্স ক্যালকুলেশনে লামির থিওরেম ব্যবহার করা হয়।
ইন্ডাস্ট্রিতে লামির ফর্মূলা
ইন্ডাস্ট্রির বিভিন্ন মেকানিক্যাল কাজ যেমন টাওয়ার ক্রেন মুভমেন্ট, কপিকল এক্সিলারেটিং ফোর্স ক্যালকুলেশনে লামির ফর্মূলা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়।
লগ ক্যালকুলেটর
ক্যালকুলেটিং ডিভাইসেও লামির ফর্মূলা ব্যবহৃত হয়। যেমনঃ লগ ক্যালকুলেটর।
ওশেনোগ্রাফি
ওশেনোগ্রাফি বা সমুদ্রবিজ্ঞানেও লামির উপপাদ্যের বিশেষ প্রয়োগ রয়েছে। সমুদ্রের পানিতে শব্দের বেগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রেও লামির থিওরেম ব্যবহৃত হয়।
লামির উপপাদ্যের সীমাবদ্ধতাঃ
- লামির উপপাদ্য শুধুমাত্র তিনটি বলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তিনের অধিক বলের জন্য লামির উপপাদ্য প্রযোজ্য নয়।
- তিনটি বল কেবল সাম্যবস্থায় থাকলেই এই সূত্র প্রযোজ্য হবে।
- তিনটি বল অসমান এবং অসমান্তরাল হওয়া আবশ্যক।
আরো কিছু আর্টিকেল পড়ুন
3D হলোগ্রাম টেকনিক এবং ডাইনির ছায়া
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল সত্যিই কি ভূতুড়ে দ্বীপ? এর নেপথ্যে রহস্য কি?