বর্তমান বিশ্ব ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র | Nuclear Power Plant

বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো পারমাণবিক শক্তি। ১৯৪৮ সালের ৩ রা সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি (Tennessee) অঙ্গরাজ্যে ওক রেজ (Oak Ridge) এর এক্স-১০ গ্রাফাইট চুল্লী ছিল বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র যেখানে পারমাণবিক শক্তি দ্বারা উৎপন্ন বিদ্যুৎ থেকে প্রথম বারের মতো একটি বাল্ব জ্বালানো হয়েছিলো। পরবর্তীতে ১৯৫১ সালের ২০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের আইদাহো (Idaho) অঙ্গরাজ্যের আর্কো (Arco) এর কাছাকাছি ইবিআর-১ (EBR-I) পরীক্ষামূলক স্টেশনে এই পরীক্ষা বৃহৎ পরিসরে চালানো হয়। ১৯৫৪ সালের ২৭ জুন সর্বপ্রথম পাওয়ার গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অবনিনিস্ক পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র (Obinisk Nuclear Power Plan) থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করা হয়। মূলত সেখান থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয়।

যার ধারাবাহিকতায় বর্তমানে বাংলাদেশেও একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। আজকের আলোচনায় আমরা এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র কি এবং পৃথিবীব্যাপী পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্বন্ধে আলোচনা করবো-

পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র কি?

যে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে পারমাণবিক শক্তিকে (nuclear energy) বৈদ্যুতিক শক্তিতে (electrical energy) রুপান্তর করা হয় তাকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বলা হয়।

পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র মূলত একটি তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র যার তাপের উৎস হলো nuclear reactor বা পারমাণবিক চুল্লি। অন্যান্য তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রেও তাপ দিয়ে বাষ্প উৎপাদন করা হয় এবং সেই বাষ্পের সাহায্যে একটি বৈদ্যুতিক জেনারেটরের সাথে যুক্ত টারবাইনকে ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করা হয়। তবে প্রচলিত তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সাথে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বেশ কিছু সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য রয়েছে।

তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র
একটি তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র (Thermal power plant)

পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে জ্বালানি হিসেবে ইউরেনিয়াম-২৩৫ (U-235) এবং থােরিয়াম-২৩২ (Th-232) অথবা বিকল্প জ্বালানি প্লুটোনিয়াম-২৩৯ (Pu-239) এর মতো ভারী উপাদানগুলোও ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র অল্প পরিমাণ পারমাণবিক জ্বালানি থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপাদন করতে পারে।

পৃথিবীব্যাপী পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রঃ

পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে। বর্তমান বিশ্বের ৩০টি দেশে প্রায় ৪৪৯ টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। এ সকল পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় তা উৎপন্ন মোট বিদ্যুতের প্রায় ১২ শতাংশ। এছাড়া আরও ১৪টি দেশে প্রায় ৬৫টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণাধীন অবস্থায় রয়েছে এবং ২০২৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশসহ আরও ২৭টি দেশে ১৭৩টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে।

নিচের চিত্রে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বর্তমান পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা দেখানো হলোঃ

বিভিন্ন দেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা

আসুন এবার আমরা পরিচিত কয়েকটি দেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য জানি।

ভারত

  • ভারতে বর্তমানে ২১ টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ চুল্লি চালু রয়েছে।
  • ৬ টি নির্মাণাধীন রয়েছে এবং ২৪ টি পারমাণবিক চুল্লি পরিকল্পনাধীন রয়েছে।
  • ২০২৪ ও ২০২৫ সাল নাগাদ যথাক্রমে ২৭,৪৮০ মেগাওয়াট  ও ৬৩,০০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করেছে।

চীন

  • চীনে বর্তমানে ৩০টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ চুল্লি চালু রয়েছে।
  • ২৪ টি নির্মাণাধীন রয়েছে।
  • ২০২০ সাল নাগাদ ৩০,০০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রা ঠিক করেছে।

দক্ষিণ কোরিয়া

  • পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিশ্বের ষষ্ঠতম দেশ।
  • ২৫ টি পারমাণবিক চুল্লি চালু রয়েছে।
  • নির্মাণাধীন রয়েছে ৩টি।
  • ২০২৪ সালের মধ্যে দেশটি মোট চাহিদার ৪৯% পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রা ঠিক করেছে।
  • দেশটিতে বর্তমানে বিদ্যুতের মোট চাহিদার প্রায় ২৮ শতাংশ পারমাণবিক  বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে।
  • দক্ষিণ কোরিয়া পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করে খুব দ্রুত উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে।

এছাড়াও ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকিপূর্ণ দেশ যেমন-ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়াও বিদ্যুৎ উৎপাদনে পারমাণবিক  প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

তেল সমৃদ্ধ মধ্য প্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত ২০২০ সালের মধ্যে ৪টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ চুল্লি নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে এবং এর মধ্যে তিনটির নির্মাণ কাজ শুরু করেছে।

আগামী বিশ বছরের মধ্যে সৌদি আরবে ১৬ টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ চুল্লি নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।

আফ্রিকা মহাদেশের নাইজেরিয়া ও কেনিয়া, ইউরোপের তুরস্ক, বেলারুশ, পোলান্ড ইত্যাদি দেশসমূহ প্রথমবারের মতো পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

তথ্যসূত্রঃ
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, wikipedia & text books

পাওয়ার প্ল্যান্ট সম্বন্ধে অন্যান্য লেখাসমূহঃ

ইউরেনিয়াম সম্বন্ধে আলোচনা
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র
রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
বাষ্প বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্বন্ধে আলোচনা।
পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইতিহাস ও সংক্ষিপ্ত আলোচনা
পাওয়ার প্ল্যান্টঃ সংজ্ঞা, প্রকারভেদ ও কার্যপদ্ধতি