২০২১ সালের মধ্যে ২৪,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে সরকার কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র সরকারের ফার্স্ট ট্র্যাক প্রজেক্টের আওতায় এগিয়ে যাচ্ছে।
গত ২০১৩ সালের ২০ এপ্রিল বাগেরহাটের জেলার রামপালের সাপমারীতে ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের মধ্যে যৌথউদ্যোগে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এরপর ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ব ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশন (এনটিপিসি) ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) এর যৌথ উদ্যোগে ভারত বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানির মাধ্যমে রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কার্যক্রম শুরু করা হয়।
ভিডিওঃ
যা যা ঘটছে একে কেন্দ্র করেঃ রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র
- ইতিমধ্যে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজের অগ্রগতি – ৪১.২১% (২০ জানুয়ারি, ২০২০)
- ভারত হেভি ইলেকট্রিক্যালস লিমিটেড (ভেল) ১.৪৯ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করবে ।
- আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করা হচ্ছে এই প্ল্যান্টে, যা সর্বোচ্চ উন্নত প্রযুক্তির নিশ্চয়তা প্রদান করে। দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ায় সাব-ক্রিটিক্যাল পাওয়ার প্লান্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে যার দক্ষতা অনেকাংশেই কম আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল এর তুলনায়।
- রামপালে আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে, যেখানে একটি সাধারণ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লা পোড়ানোর দক্ষতা ২৮%, সেখানে আলট্রা-সুপারক্রিটিক্যাল পাওয়ার প্লান্টের দক্ষতা ৪২-৪৩%। অর্থাৎ একই পরিমাণ কয়লা পুড়িয়ে দেড়গুণ বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব।
- আশার কথা হচ্ছে সবচেয়ে উন্নতমানের কয়লা এখানে ব্যবহার করা হবে। কয়লা আমদানি করা হবে কয়েকটি দেশ থেকে তার মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকা রয়েছে
- সাব-ক্রিটিক্যাল এবং আলট্রা-সুপারক্রিটিক্যাল প্লান্টের মধ্যে রাত দিন পার্থক্য রয়েছে। সাব-ক্রিটিক্যালের তুলনায় সুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিতে প্রায় ৪০% কার্বন, সালফার ও নাইট্রোজেন গ্যাস নিঃসরণ কম হয়। থিওরেটিক্যালি আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল প্লান্টে যে কোন প্রকারের দূষণের মাত্রা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা সম্ভব। এছাড়াও একটি সাব – ক্রিটিক্যাল প্লান্টের সার্বিক দক্ষতা সাধারণত ২০-২৫ %, সুপার- ক্রিটিক্যাল প্লান্টের দক্ষতা ৩০ -৩৫ % এবং আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির একটি প্লান্টের ৪০+% বেশি দক্ষতা রয়েছে। একটি সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির প্লান্টে যে পরিমান কয়লা ব্যবহার হবে একটি সাব- ক্রিটিক্যাল প্লান্টে তার চেয়ে দ্বিগুন পরিমানে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আর যত বেশি কয়লা পুড়বে তত বেশি দূূষণ হবে, তাই আমাদের দেখতে হবে কোথায় কম কয়লায় বেশী শক্তি পাওয়া সম্ভব হচ্ছে।
এক নজরে কিছু তথ্য দেখে নেওয়া যাকঃ
- লোকেশনঃ খুলনার বাগেরহাটের রামপালে
- অপর নামঃ মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট
- মালিকানাঃ বিপিডিবি+ এনটিপিসি
- কোম্পানির নামঃ BIFPCL (Bangladesh-India Friendship Power Company Limited)
- ইউনিট সংখ্যাঃ ২
- ক্ষমতাঃ ২*৬৬০ মেগাওয়াট = ১৩২০ মেগাওয়াট
- জ্বালানিঃ কয়লা (বিটুমিনাস+সাব-বিটুমিনাস গ্রেড)
- দিনপ্রতি কয়লা লাগবেঃ ১২,৯২০ টন
- বার্ষিক কয়লা চাহিদাঃ ৪.৭২ মিলিয়ন মেট্রিক টন
- চিমনির উচ্চতাঃ ২৭৫ মিটার
- ছাই উৎপাদনঃ ০.৫ মিলিয়ন টন
- সুন্দরবনের কার্বন শোষণের ক্ষমতাঃ ৪.২ মিলিয়ন কেজি
- প্ল্যান্টের বার্ষিক কার্বন নির্গমণঃ ৩.১৬ মিলিয়ন কেজি
- সুন্দরবন থেকে প্ল্যান্টের দূরত্বঃ ১৪ কিমি
- প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরঃ ৫৮-৬০%
- প্রজেক্ট এলাকাঃ ৯১৫ একর (এর মধ্যে ৪৬৫ একরে মূল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হবে, বাদ বাকী জায়গায় সোলার প্যানেল বসবে এবং সবুজায়ন (Green Belt) করা হবে। )
- খরচঃ ১.৪৯ বিলিয়ন ডলার
- প্রতি ঘন্টায় পানি লাগবে কুলিং এর জন্যেঃ ১৪৪ কিউসেক
- লাইফটাইমঃ ৪০ বছর(ধরা হয়েছে)
এছাড়াও রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ইএসপি (Electrostatic Precipitator) থাকবে যা উদগীরণকৃত ফ্লাই অ্যাশের প্রায় ৯৯.৯৯ % ধরে রাখতে সক্ষম হবে। এই ছাই সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে ব্যবহৃত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। একইভাবে এফজিডি (Flue gas desulphurization) স্থাপনের ফলে ৯৬% সালফার গ্যাস শোষিত হবে, যা বায়ুমন্ডলে ছড়িয়ে পড়া থেকে বিরত রাখবে । এই প্রস্তাব করা হয়েছে যে এই সালফার গ্যাস থেকে জিপসাম সার তৈরি হবে ।
রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চিমনীর উচ্চতা হবে ২৭৫ মিটার, সবচেয়ে উচ্চতা বিশিষ্ট , যার ফলে চিমনী দিয়ে যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বের হবে তা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১.৬ কিলোমিটারের(বাফার জোন) মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। অন্য যে সমস্ত ক্ষতিকর গ্যাস সামান্য পরিমাণে নির্গত হবে সেগুলোর ঘনত্ব(পিপিএম) বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা(WHO) এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার স্বীকৃত মাত্রার চেয়ে অনেক কম থাকবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে।
পাশাপাশি দূষণ প্রতিরোধে সর্বাধুনিক যত ধরণের প্রযুক্তি পাওয়া যায় সেগুলো ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে। ফ্লু গ্যাস টেম্পারেচার, নাইট্রোজেন, সালফার-ডাই-অক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড ইত্যাদির নিঃসরণ পর্যবেক্ষণের জন্য রিয়েল টাইম কন্টিনিউয়াস এমিশন মনিটরিং সিস্টেম (CEMS) থাকবে যাতে কোন সমস্যা দেখা দিলে রিয়েল টাইম মনিটরিং করে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। পাশাপাশি বাকিসব সমস্যা নিয়ন্ত্রণে দূষণ নিয়ন্ত্রণকারী যন্ত্রপাতি বসানো হবে।
ইউনেস্কো প্রথম থেকেই এই প্ল্যান্ট নির্মাণের বিপক্ষে ছিল, পরবর্তীতে তারা তাদের অবস্থান থেকে সরে আসে যখন তারা দেখে যে এই প্ল্যান্টের জন্য গৃহীত ব্যবস্থাদি অনেক উচুমানের, ফলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সুন্দরবনের কাছে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির যে আপত্তি ছিল তা তারা প্রত্যাহার করে নিয়েছে–BBC BANGLA
প্ল্যাণ্টের ব্যবহৃত পানি কি নদীতে ফেরত যাবে?
বলা হয়েছে যে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য পশুর নদী থেকে প্রতি ঘন্টায় ১৪৪ কিউসেক পানি নেওয়া হবে। দেখা গেছে পশুর নদীর পানিতে লবন আছে। সেই পানি সরাসরি ব্যবহার করা যাবে না ফলে তা ফিল্টারিং করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহার করা হবে। ব্যবহৃত পানি চিলার বা কনডেন্সার এর দ্বারা শীতল করে পুনরায় বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহার উপযোগী করা হবে। কোন দূষিত বা গরম পানি পশুর নদীতে ফেলা হবে না বলে প্ল্যান্ট ডিরেক্টর এর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এছাড়াও যে পরিমাণ পানি উত্তোলন করা হবে তা মোট পানি প্রবাহের তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য। শুষ্ক মৌসুমে পশুর নদীর মোট পানি প্রবাহের মাত্র (০.০৫%) অর্থাৎ ২ হাজার ভাগের এক ভাগ পানির প্রয়োজন হবে প্ল্যান্টের শীতলীকরণের জন্যে।
শব্দ দূষনের রোধের ব্যাপারে গৃহীত পদক্ষেপসমূহঃ
বিদেশ থেকে জাহাজে করে কয়লা রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পরিবহনের সময় সুন্দরবন এলাকায় শব্দ দূষণ, আলো দূষণ ইত্যাদির বিষয় গুলো নিয়ে সরকার এ বিষয়ে সম্পূর্ণ সজাগ। শব্দ, আলো , পানি দূষণ সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখার জন্য কোম্পানি+সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরণের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কিভাবে আনা হবে এই কয়লা?
বাংলাদেশের গভীর সমুদ্র হতে বার্জে করে (ঢাকনাযুক্ত) আমদানিকৃত কয়লা পরিবহন করা হবে সুন্দরবনের রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। সেই কয়লাবাহী বার্জে ব্যবহৃত হবে ঢাকনাযুক্ত কম শব্দযুক্ত ইঞ্জিন, ফলে শব্দ দূষণ অনেকাংশেই হ্রাস পাবে। সেই সাথে ফলে পরিবেশ দূষণের কোন সম্ভাবনা নেই বলা যাবে না, কিন্তু সেই দূষনের মাত্রা অনেক কম থাকবে। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা থাকবে, যার ফলস্বরূপ আশেপাশে সবুজ বেষ্টনী তৈরির মাধ্যমে প্ল্যান্টের শব্দ ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সুন্দরবনে পৌঁছাবেনা। প্ল্যান্ট এরিয়ার ২০০ মিটারের মধ্যে যাতে সীমাবদ্ধ থাকে সে বিষয় সর্বাক্ষণিক তদারকি করা হবে।
কেন এত বিতর্কিত এই প্ল্যান্টঃ
- রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হলে সেই অঞ্চলে ও আশেপাশের এরিয়ায় ইকোলজিক্যাল ইমব্যালেন্স তৈরি হবে যার ফলশ্রুতিতে সুন্দরবনের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য বিনষ্ট হবে, তৈরী হবে অসংখ্য কয়লা রাখার ডিপো ,শুরু হবে নির্বিচারে গাছ কাটা-জায়গা বাড়ানোর জন্যে, বনে আগুন লাগানো, বাঘ, হরিণ, কুমির ধরা পড়বে যাতে নির্বিঘ্নে চলাচল করেতে পারে মানুষ প্ল্যান্ট এরিয়ায়।
- কয়লা পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট ধোঁয়া থেকে উৎপন্ন সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন ইত্যাদি সুন্দরবনের জৈবিক পরিবেশ ও বায়ুমন্ডলকে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করবে বলে আশংকা করা হচ্ছে ।
- বায়ুমন্ডলে প্ল্যান্ট থেকে উন্মুক্ত হওয়া সালফার ডাই-অক্সাইড ও কার্বনঘটিত যৌগসমূহ থেকে সৃষ্ট গ্রিনহাউজ গ্যাস বহনের ফলে অতি মারাত্মক ক্ষতিকর এসিড বৃষ্টি ঘটাবে যা এলাকার বিল্ডিং, যন্ত্রপাতি, ফসলি জমি,গাছপালার পাতা, পশুপাখি ইত্যাদির ক্ষতি করবে। জমি তার উর্বরতা হারিয়ে ফেলবে আগের তুলনায়।
- উক্ত অঞ্চল এবং আশেপাশের কৃষি জমিতে উৎপাদিত কৃষি পণ্য খেলে মানব দেহে ছড়িয়ে পড়বে অ্যাজমা,হাঁপানিসহ ফুসফুসবাহিত নানান ধরনের রোগ, এমনকি মরণব্যাধি রোগ ক্যান্সারের সমূহ সম্ভাবনাও থাকবে কেনোনা কয়লার বিষাক্ত বর্জ্য ছড়িয়ে পড়বে মাটিতে,পানিতে,আশেপাশের পরিবেশে।
এছাড়াও কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের টার্বাইন(ব্লেড ), কম্প্রেসর, ওয়াটার পাম্প, কুলিং টাওয়ার কনস্ট্রাকশনের যন্ত্রপাতি, পরিবহনের যানবাহনের মাধ্যমে ব্যাপক শব্দদূষণ ঘটবে যা বলার অপেক্ষা রাখে না। মূলত এ সমস্ত কারণেই আবাসিক এলাকা, কৃষিজমি এবং বনাঞ্চলের আশেপাশে কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করার অনুমতি প্রদান করা হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে সুন্দরবনের মত স্পর্শকাতর অঞ্চলের কাছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে যা দেশের মানুষকে এর ক্ষতিকর সূদূরপ্রসারী প্রভাব সম্পর্কে ভাবতে বাধ্য করেছে, যার ফলে এটি বিতর্কিত হয়ে পড়েছে।
সাধারণত কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অনেকটাই নোংরা এবং মারাত্মক পরিবেশ দূষণ ঘটায় বলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংরক্ষিত বনভূমি ও বসতির আনুমানিক ১৫- ২০ কিলোমিটার এর মধ্যে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয় না। ইআইএ রিপোর্ট অনুসারে বলা হয়েছে যে প্রস্তাবিত ১৩২০ মেগাওয়াট রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পটি সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে যা সরকার নির্ধারিত সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার পরিবেশগত সংরক্ষিত বিপদাপন্ন অঞ্চল থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার বাইরে অবস্থিত থাকায় তথাকথিত ভাবে নিরাপদ হিসেবে দাবি করা হয়েছে।
ইআইএ রিপোর্ট অনুসারে, এটাও জানানো হয়েছে যে রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র চলাকালীন ৪০ বছর ধরে এই ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৪২ টন, বছরে ৫১,৮৩০ টন বিষাক্ত সালফার ডাইঅক্সাইড (SO2) ও ্দিনপ্রতি ৮৫ টন, বছরে ৩১,০২৫টন বিষাক্ত নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড(NO2) বায়ুমন্ডলে নির্গত হবে।
এই রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রে বছরে ৪৭,২০,০০০ টন কয়লা পুড়িয়ে ৭,৫০,০০০ টন ফ্লাই অ্যাশ ও ২,০০,০০০ টন বটম অ্যাশ উৎপাদিত হবে।
সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে কয়লা পরিবহনের ফলাফল
সরকারি পরিকল্পনা মোতাবেক, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য বছরে ৪৭,২০,০০০ টন কয়লা ইন্দোনেশিয়া, অষ্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে সমুদ্র পথে আমদানি করতে হবে। আমদানিকৃত এত পরিমাণ কয়লা জাহাজের মাধ্যমে মংলা বন্দরে এনে তারপর সেখান থেকে সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে।
কিন্তু সুন্দরবনের ভেতরে প্রবাহমান পশুর নদীর নাব্যতা সর্বত্র বড় জাহাজের চলাচলের জন্য উপযুক্ত না হওয়ার কারণে প্রথমে বড় জাহাজে করে কয়লা সুন্দরবনের নিকটস্থ আকরাম পয়েন্ট পর্যন্ত বয়ে আনতে হবে, তারপর সেই আকরাম পয়েন্ট থেকে একাধিক ছোট ছোট লাইটারেজ জাহাজে করে কয়েক ধাপে কয়লা মংলাবন্দরে নিয়ে যেতে হবে। এর জন্য সুন্দরবনের ভেতরে হিরণ পয়েন্ট থেকে আকরাম পয়েন্ট পর্যন্ত প্রায় ৩০ কি.মি নদী পথে বড় জাহাজ প্রতি বছরে ৫৯ দিন এবং আকরাম পয়েন্ট থেকে মংলা বন্দর পর্যন্ত প্রায় ৬৭ কি.মি পথ ছোট লাইটারেজ জাহাজে করে বছরে ৩৬৫ দিন এর মধ্যে ২৩৬ দিনই হাজার হাজার টন কয়লা রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পরিবহন করতে হবে। কয়েক ধাপে লোড আনলোড করার ফলে কয়লা বাতাসে মেশার একটা চান্স থেকেই যাচ্ছে, যার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, যতই সেফটি মেইন্টেইন করা হউক না কেন।
এবার আসি অর্থায়ন সম্পর্কিত বিতর্কেঃ
জানামতে এই প্রকল্পের অর্থায়ন করবে ১৫% বি পি ডি বি, ১৫% ভারতীয় পক্ষ আর ৭০% ঋণ নেয়া হবে ভারতের এক্সিম ব্যাংক হতে। যে নীট লাভ হবে সেটা ভাগ করা হবে ৫০% হারে, ফলে দেখা যাচ্ছে রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পে মাত্র ১৫% বিনিয়োগে ভারতীয় কোম্পানির মালিকানা ৫০%, যা দেশের মানুষকে ভাবাচ্ছে। উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিনবে বি পি ডি বি, মানে মালিকানা থাকার পর ও দেশের বিদ্যুৎ কিনেই তা ব্যবহারের লাইসেন্স পেতে হবে।
উভয়ের সিদ্ধান্তমতে রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম নির্ধারিত হবে একটা ফর্মুলা অনুসারে। সেই ফর্মুলা হচ্ছে যদি কয়লার দাম প্রতি টন ১০৫ ডলার হয় তবে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ এর দাম হবে ৫.৯০টাকা এবং প্রতি টন কয়লা ১৪৫ ডলার হলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ৮.৮৫ টাকা দরে কিনতে হবে, যা বর্তমানের বাজার দরের দ্বিগুণ বলা চলে।
উপরোক্ত কারণে এই প্ল্যান্ট অনেকটাই বিতর্কিত।
বিকল্পঃ
সন্দীপ চ্যানেলের ৫.৫ নটিক্যাল মাইল / ঘন্টার সমুদ্রস্রোত ঠিকমত ব্যবহার করতে পারলে আমরা সেখান থেকেই ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম হব। বঙ্গোপসাগর জুড়ে আমরা যদি সমুদ্র স্রোত কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করতে পারি তাহলে আমরা ক্লিন এনার্জি খুব সহজেই পাব, সেই সাথে কয়লায় মত নোংরা জ্বালানি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে পারবো। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারেও আমরা এই প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে পারি।
উন্নত দেশের তুলনায় আমাদের দেশের কার্বন নির্গমনের হার অনেকাংশেই কম, জনপ্রতি মাত্র ০.৪ মেট্টিক টন, উন্নত দেশের জন্যে যা ১০ মেট্টিক টন, ফলে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে আমাদের ভূমিকা অতি নগন্য।