গল্পে গল্পে ইল মাছের বৈদ্যুতিক রহস্য উদঘাটন

অনেকদিন আগের কথা। এক বিজ্ঞানী তার রিসার্চ টিম নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিল ব্রাজিলের আমাজন জঙ্গলে। তাদের উদ্দেশ্যে ছিল দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদীর বিভিন্ন প্রজাতির মৎস্য নিয়ে গবেষণা করা। তারা পৌছে গেল ব্রাজিলের আমাজন জঙ্গলে যার পাশ দিয়েই বয়ে যাচ্ছে আমাজন নদী। তারা আমাজন জঙ্গলেই তাবু স্থাপন করল। তারপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েই বেরিয়ে পড়ল বিভিন্ন প্রজাতির মাছের অনুসন্ধানে।

আমাজন নদীর স্বচ্ছ পানিতে তারা এক ধরনের কালচে ধূসর বর্ণের বেলনাকৃতির মাছ দেখতে পেল। তাদের মধ্যে একজন মাছটিকে তুলে আনার চেষ্টা করল। কিন্তু সাথে সাথে ঘটল অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। মাছটিকে স্পর্শ করার সাথে সাথেই লোকটি শক অনুভব করল যেন একটা জেনারেটর এ হাত লাগিয়েছে সে। লোকটি দারুণভাবে আহত হল। এ ঘটনার পর তাদের চিফ রিসার্চারের আগ্রহ যেন আরো বেড়ে গেল। তারপর তারা এই রহস্যময় মাছটিকে পরীক্ষা করার জন্য তাদের দেশে নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে তারা গবেষণা করে জানতে পারল মাছটি ইল মাছ। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন যেটা আপনাদের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে সেটি হল এই মাছটিতে কিভাবে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপন্ন হচ্ছে? আসলে এসব প্রজাতির মাছে EOD বিদ্যমান।

EOD কি?

মাছের স্নায়ুকোষ রুপান্তরিত হয়ে এক ধরনের বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে যা বৈদ্যুতিক চার্জ ধারণ করে রাখে আর একেই বলা হয় EOD (Electrical Organic Discharge). ইল মাছেও এই বিশেষ ধরনের কোষ বিদ্যমান যা মাছটির ৮০% অংশ জুড়ে বিদ্যমান। যা মাছটিকে রীতিমতো বৈদ্যুতিক কোষে রুপান্তর করেছে। এই অংশের সাহায্যে মাছটি উচ্চ ও নিম্ন দুই ধরনের ভোল্টেজ তৈরি করতে পারে। তবে সব মাছে EOD এর প্রকৃতি এক রকম হয়না। এই EOD এর ভিত্তিতে সিগন্যাল জেনারেশান ও ভিন্ন হয়। EOD এর প্রকৃতি দুই ধরনের। যথা-

১) পালস টাইপ
২) ওয়েব টাইপ

পালস টাইপ

সাধারণত যে সকল মাছে শক্তিশালী বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র বিদ্যমান তারাই পালস টাইপ বিদ্যুৎ জেনারেট করে।

অনেকটা বজ্রপাতের ন্যায়। খুব অল্প সময়ের জন্য উচ্চ ভোল্টেজ এর বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। যেমন- ইল মাছ, ক্যাটফিশ, ইলেক্ট্রিক রে।

ওয়েব টাইপ

সাধারণত যে সকল মাছে দুর্বল বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র বিদ্যমান তারাই পালস টাইপ বিদ্যুৎ জেনারেট করে। যেমন- Knife Fish, Elephant Nose

আবার সব মাছ বিদ্যুৎ তৈরি করতে পারেনা। কিছু মাছ বিদ্যুৎ অনুধাবন করতে পারে মাত্র। যেমন- Shark, Paddle Fish.

Shark, Paddle Fish কিভাবে বিদ্যুৎ বা সামনের যেকোন জিনিস অনুধাবন করতে পারে?

Shark, Paddle Fish এসব মাছের দেহে সাধারণত electroreceptors থাকে যা তাদের বিদ্যুৎ, রাতের বেলায় অস্বচ্ছ পানিতে সামনের যেকোন বস্তুর উপস্থিতি অনুধাবনে সাহায্য করে। আর এই প্রক্রিয়াকে “Active Electrolocation” বলা হয়।

ইল মাছ কখন নিম্ন ভোল্টেজ এবং কখন উচ্চ ভোল্টেজ তৈরি করে?

সাধারণত ইল মাছ চলাফেরা, জৈবিক কার্যাবলি, চারপাশের পরিবেশ অনুধাবনের সময় নিম্ন ভোল্টেজ উৎপন্ন করে।

কিন্তু যখন কোন শিকারি তাকে আঘাতের প্রচেষ্টা করে তখন সে উচ্চ ভোল্টেজ তৈরি করে। এই ভোল্টেজ এর মাত্রা ২ থেকে ৫০০ ভোল্ট পর্যন্ত হতে পারে।

দেহে কিভাবে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হচ্ছে?

যখন কোন শিকারি তার সংস্পর্শে আসে তখন মাছটির স্নায়ুকোষ উদ্দীপিত হয় এবং EOD কোষে সিগন্যাল প্রেরণ করে।

তখন EOD কোষের ইলেক্ট্রোলাইট (বৈদ্যুতিক আয়ন) গুলো চলাচল শুরু করে। অত:পর এই আয়নগুলো দেহের সোডিয়াম আয়ন কতৃক আকর্ষিত হয়ে ডাইপোল সৃষ্টি করে। যা ব্যাটারীর মত কাজ করে। এই সোডিয়াম আয়ন ও ইলেক্ট্রোলাইট প্রান্তের মধ্যে বিভব পার্থক্য সৃষ্টি হয়। যার ফলে ইল মাছের মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত বিদ্যুৎ প্রবাহ সৃষ্টি হয়। এই প্রবাহমাত্রার মান সর্বোচ্চ ১ এম্পিয়ার হতে পারে। স্নায়ুকোষের উদ্দীপনার উপর এই প্রবাহমাত্রা নির্ভর করে।

ইল মাছ ; ইল মাছের দেহের ইলেক্ট্রিক্যাল ফিল্ড
ইল মাছের দেহের ইলেক্ট্রিক্যাল ফিল্ড

ইল মাছ যে জলাশয়ে অবস্থান করছে সে জলাশয়ের অন্যান্য প্রাণীদের কি অবস্থা হবে?

এটি স্বচ্ছ পানিতে বাস করে। আর স্বচ্ছ পানি বিদ্যুৎ কুপরিবাহী। যদি কোন কারণে পানিতে রাসায়নিক পদার্থ বেশি হয় তখন ব্যাপারটি ভিন্ন। ইল মাছ পানিতে যখন সাধারণভাবে চলাচল করে তখন অল্পমানের ভোল্টেজ তৈরি করে। তাই তার বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের বিস্তার কম। কম হলেও বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের আওতায় যদি কোন প্রাণী চলে আসে তাহলে সে শক অনুভব করবে। কিন্তু যদি কোন জলজ প্রাণী তাকে আক্রমণের চেষ্টা করে তাহলে সেক্ষেত্রে উচ্চমানের ভোল্টেজ সৃষ্টি করে সেই প্রাণীকে নাজেহাল করে ছাড়বে। এমনকি মানুষের উপরও এই বিদ্যুৎ এর প্রভাব বেশ প্রাণঘাতী হতে পারে।

ইল মাছ ; ইল মাছের বৈদ্যুতিক প্রভাব
ইল মাছের বৈদ্যুতিক প্রভাব

বিদ্যুৎ নিয়ে আরো অজানা তথ্য জানুন

বিদ্যুৎ নিয়ে কিছু মজার এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যা আপনার জেনে রাখা উচিত

লোডশেডিং কি ও জনসাধারণের ধারণা এবং কারিগরি বাস্তবতা | বিদ্যুৎ গেলেই কি লোডশেডিং