একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে কোটি কোটি টাকার মূলধন প্রয়োজন হয়, প্রয়োজন হয় বিপুল সংখ্যক জনবল। কিন্তু এত মূলধন খরচ করে যদি একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র ভুল স্থানে নির্মাণ করা হয় সেক্ষেত্রে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সম্পূর্ণ ধ্বংস বা অচল হয়ে যেতে পারে। এছাড়া স্থান নির্বাচনের উপর একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্থাপন খরচ, পরিচালনা খরচ, স্থায়ীত্ব ও মুনাফা নির্ভর করে।
তবে সব ধরনের স্থানে সব ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্রর জন্য সকল দিক থেকে উপযােগী বা সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। তাই যে কোন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো উপযুক্ত স্থান বা এলাকা নির্বাচন।
এই লেখাতে আমরা একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য উপযুক্ত স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়সমূহ নিয়ে আলোচনা করবো।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ বিবেচনা করতে হয়ঃ
১. মাটির কঠিনতা (Soil strength)।
২. পারমাণবিক জ্বালানির প্রাচুর্য (Availability of nuclear fuels)।
৩. জনশূন্য এলাকা (Nonpopulated area)।
৪. পানির প্রাচুর্য (Availability of water)।
৫. পরিবহন ও যােগাযােগের সুবিধা (Transport and Communication Facilities)।
৬. বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীর প্রাচুর্য (Availability of consumers)।
৭. বর্জ্য নিস্পত্তি (Disposal of waste)।
১. মাটির কঠিনতা (Soil strength):
যেহেতু একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হতে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ শক্তি উৎপন্ন হয়, এজন্য এখানে যে বাষ্প টারবাইন (water turbine) ও বৈদ্যুতিক জেনারেটর ব্যবহার করা হয় তার আকারও অনেক বড় হয় এবং এসব থেকে সৃষ্ঠ কম্পনের পরিমাণও অনেক বেশি হয়। যদি উপযুক্ত শক্ত মাটিতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা না হয় তাহলে পাওয়ার হাউজে যে কম্পনের সৃষ্টি হবে তাতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র তার আনুষাঙ্গিক যন্ত্রপাতিসহ ভেঙে যেতে পারে বা নিচের দিকে ধ্বঁসে যেয়ে মারাত্মক দূর্ঘটনা সৃষ্টি করতে পারে। যার ফলে এই ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য এলাকা নির্বাচনের ক্ষেত্রে অবশ্যই শক্ত মাটিযুক্ত এলাকা বাছাই করতে হবে।
২. পারমাণবিক জ্বালানির প্রাচুর্য (Availability of nuclear fuels):
যে কোন তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান উপাদান হচ্ছে জ্বালানি। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জ্বালানি হিসেবে ইউরেনিয়াম-২৩৫ (U-235) ব্যবহার করা হয়। যা খুবই তেজস্ক্রিয় এবং প্রাকৃতিক খনি হতে সংগ্রহ করতে হয়। এছাড়া একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে চালু রাখতে ও দুর্ঘটনা মোকাবেলা করতে হলে সঠিক সময়ে জ্বালানি সরবরাহের ব্যবস্থা রাখতে হবে। যদি নিজ দেশে ইউরেনিয়াম এর প্রাচুর্য না থাকে তাহলে অন্য কোন দেশ হতে চুক্তি বা সমযোতার ভিত্তিতে এই জ্বালানি আমদানি করার সুবিধা থাকতে হবে। অন্যথায় এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনা করা সম্ভব হবে না।
৩. জনশূন্য এলাকা (Non-populated area):
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে অবশ্যই জনশূন্য এলাকা বাছাই করা উচিত, কেননা রিয়্যাক্টরের মধ্যে পারমাণবিক জ্বালানির যে বিক্রিয়া ঘটে তা থেকে প্রচুর তেজস্ক্রিয় রশ্মি নির্গত হয়। এই রশ্মি যদি কোন কারণে রিয়্যাক্টর দন্ডের কোনাে ছিদ্র অথবা ফাটলের মাধ্যমে বাইরে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে তা জীব জন্তু ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় নাগাসাকি এবং হিরােশিমায় যে দুটি পারমাণবিক বােমা বিস্ফোরিত হয়েছিল, তাতে তৎক্ষণাৎ অগণিত জীব জন্তু মারা যায়, সব কিছু ধ্বংস হয়ে যায় এবং সেই পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে তখন হতে আজ পর্যন্ত সেই এলাকার মানব সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত, অন্ধ এবং পঙ্গু হচ্ছে।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, জনশূন্য স্থান বাছাই করতে যেয়ে যে এলাকায় অনেক বন্য প্রাণীর বিচরণ রয়েছে এবং যে স্থানের বনভূমি প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার্থে বৃহৎ ভূমিকা পালন করছে এরুপ স্থান নির্বাচন করাও মোটেও কাম্য নয়। যেমনঃ যদি সুন্দরবনের কাছাকাছি কোন স্থানে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হলে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটবে।
৪. পানির প্রাচুর্য (Availability of water):
যেহেতু পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র শীতলীকরণের জন্য পর্যাপ্ত পানি প্রয়োজন হয় সেহেতু এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র এমন জায়গায় স্থাপন করা উচিত যেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পাওয়া যায়। যেমন – কোনও নদী বা সমুদ্রের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল।
৫. পরিবহন ও যােগাযােগের সুবিধা (Transport and Communication Facilities):
যদি যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থা ভালো না হয় তাহলে কখনোই একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনা করা সম্ভব হবে না।পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যে এলাকায় স্থাপন করতে হবে সেখানে পরিবহন ও যোগাযোগের পর্যাপ্ত সুবিধা থাকতে হবে যাতে নির্মাণের সময় ভারী সরঞ্জাম পরিবহন করা যায় এবং প্ল্যান্টে নিযুক্ত শ্রমিকদের চলাচল সহজ হয়। তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু করার পূর্বে সে স্থানে যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় সময়মতো পণ্য সরবরাহের অভাবে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনা করা যাবে না। এছাড়া জরুরি তথ্য আদান প্রদান করার জন্য ব্রডব্যান্ড, ইন্টারনেট, টেলিফোন, পােস্ট অফিস, কুরিয়ার সার্ভিস ইত্যাদিরও সুবিধা থাকা প্রয়োজন।
৬. বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীর প্রাচুর্য (Availability of consumers):
যেহেতু একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হতে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপন্ন হয়, সেহেতু এই উৎপাদিত বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্যে বড় ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে এরুপ অঞ্চল থেকে কিছুটা নিকটবর্তী স্থানেও এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা যেতে পারে। যার ফলে বিদ্যুৎ সরবরাহ ও বন্টন ব্যয় অনেক কম হবে এবং গ্রাহকরাও কম খরচে বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে দূর্ঘটনার ক্ষতি এড়াতে নূন্যতম নিরাপদ দুরত্ব বজায় রাখতে হবে।
৭. বর্জ্য নিস্পত্তি (Disposal of waste):
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিভাজন (fission) দ্বারা উৎপাদিত বর্জ্য সাধারণত তেজস্ক্রিয় হয় যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি। এই ঝুঁকি এড়াতে পারমাণবিক বর্জ্য সঠিকভাবে নিষ্পত্তি করতে হবে। এসব বর্জ্য হয় গভীর খাদে সমাহিত করা উচিত অথবা সমুদ্রের তীর থেকে অনেক দূরে সমুদ্রের মধ্যে ফেলে দেওয়া উচিত। সুতরাং, এসকল তেজস্ক্রিয় বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
উল্লিখিত বিষয়গুলো থেকে এটি স্পষ্ট যে, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য আদর্শ অঞ্চল হলো সমুদ্র বা নদীর কাছাকাছি এবং ঘন জনবহুল অঞ্চল থেকে দূরে রয়েছে এমন অঞ্চল।
পাওয়ার প্ল্যান্ট সম্বন্ধে অন্যান্য লেখাসমূহঃ
তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য উপযুক্ত এলাকা নিরবাচনে বিবেচ্য বিষয়সমূহ।
পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য উপযুক্ত এলাকা নিরবাচনে বিবেচ্য বিষয়সমূহ।
প্রচলিত তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সুবিধা ও অসুবিধা।
ইউরেনিয়াম সম্বন্ধে আলোচনা।
বর্তমান বিশ্ব ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
বাষ্প বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্বন্ধে আলোচনা।
পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইতিহাস ও সংক্ষিপ্ত আলোচনা।
পাওয়ার প্ল্যান্টঃ সংজ্ঞা, প্রকারভেদ ও কার্যপদ্ধতি।