স্টিম পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্য স্থান নির্বাচন | Choice of Site for Steam Power Plant

শিল্প বা কলকারখানায় মূলধন খাটানাে হয় মুনাফার জন্য। যে কোনাে প্রতিষ্ঠান স্থাপনের পূর্বে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়। পরিকল্পনাটি যত সঠিক হবে প্রতিষ্ঠানটিতে লাভের পরিমাণ তত বেশি হবে। আবার ভূল পরিকল্পনায় মূলধন নষ্ট হবার আশংকা বেশি থাকে। সুতরাং সঠিক পরিকল্পনার সাথে লাভ বা মুনাফা ওতপ্রােতভাবে জড়িত।

একটি পাওয়ার প্লান্ট স্থাপন করতে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়। কিন্তু এই পাওয়ার প্ল্যান্ট যদি ভুল স্থানে নির্মাণ করা হয় সেক্ষেত্রে কেন্দ্রটি সম্পূর্ণ ধ্বংস বা অচল হয়ে যেতে পারে। এছাড়া স্থান নির্বাচনের উপর প্রতিষ্ঠানটির স্থাপন খরচ, পরিচালনা খরচ, স্থায়ীত্ব ও মুনাফা নির্ভর করে। তাই একটি পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য উপযুক্ত স্থান বা এলাকা নির্বাচন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে একই ধরনের স্থানে সব ধরনের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সকল দিক থেকে উপযােগী বা সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। তাই বিভিন্ন পাওয়ার প্লান্টের জন্য স্থান বা এলাকা নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন শর্ত বা দিক বিবেচনা করা হয়। 

আজ আমরা একটি বাষ্প বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বা Steam Power Plant এর জন্য উপযুক্ত স্থান বা এলাকা নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে সকল শর্ত বিবেচনা করা হয় তা নিয়ে আলোচনা করবো।

স্টিম পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য উপযুক্ত স্থান নির্বাচনের শর্ত সমূহঃ

একটি বাষ্প বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের জন্য উপযুক্ত এলাকা নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত শর্ত সমূহ বিবেচনা করতে হয়ঃ

  1. জ্বালানি সরবরাহ (Supply of fuel)
  2. পরিবহন ও যােগাযােগের সুবিধা (Transport and communication facilities)
  3. মাটির কঠিনতা (Soil Strength)
  4. পানি সরবরাহের সুবিধা (Water supply facilities)
  5. শ্রমিকের প্রাচুর্য (Availability of Laborers)
  6. যন্ত্রাংশের প্রাচুর্য (Availability of Equipment parts)
  7. শিল্প ও বাণিজ্যিক এলাকা (Industrial and Commercial areas)
  8. বাজারের সুবিধা (Market facilities)
  9. জনবহুল অঞ্চল থেকে দূরে (Distance from populated area)

1. জ্বালানি সরবরাহ (Supply of Fuel):

যেহেতু বাষ্প বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে প্রধান জ্বালানি হিসেবে সাধারণত কয়লা ব্যবহার করা হয় এছাড়াও প্ল্যান্টের বিভিন্ন কাজে অন্যান্য জ্বালানিও ব্যবহার করা হয়ে থাকে সেহেতু এই কেন্দ্র কয়লা খনির কাছাকাছি স্থাপন করা উচিত এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য জ্বালানি আধারে মজুদ করে রাখা উচিত। এতে করে জ্বালানি পরিবহন করা অত্যন্ত সুবিধাজনক হবে। তবে এ ধরণের এলাকায় যদি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের সুযোগ না থাকে সেক্ষেত্রে স্থাপনের জন্য এমন এলাকা বাছাই করা উচিত যেখানে সারা বছর যথাযথ পরিবহন সুবিধা রয়েছে। 

বড় পুকুরিয়া কয়লার খনি

2. পরিবহন ও যােগাযােগের সুবিধা (Transport and Communication Facilities):

বাষ্প বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রচুর পরিমাণে কয়লা বা জ্বালানির প্রয়ােজন হয়। এছাড়া প্রয়ােজনীয় খুচরা যন্ত্রাংশ আনা-নেয়া, বয়লার ও পাওয়ার হাউজে কর্মরত কর্মচারীদের বিভিন্ন কাজে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করতে হয়। যেখানে মােটামুটিভাবে স্থলপথ, জলপথ ও আকাশপথে যাতায়াতের সুবিধা রয়েছে, সেখানে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বাষ্প বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা যুক্তি সঙ্গত। এতে করে দূর দূরান্ত বা বিদেশ হতে জাহাজের মাধ্যমে কয়লা, খুচরা যন্ত্রাংশ, ক্রুড অয়েল ইত্যাদি প্রয়ােজন মােতাবেক অল্প সময়ের মধ্যে সংগ্রহ করে পাওয়ার প্ল্যান্টের উৎপাদন কাজ স্বাভাবিক রাখা যায়।

আবার দেশের ভিতরে কোথাও হতে কয়লা, ক্রুড অয়েল, যন্ত্রাংশ ইত্যাদি আনা-নেওয়ার প্রয়ােজন হলে রেলপথ ও সড়ক পথে এই কাজ সহজেই পরিবহন করা যায়। এছাড়া জরুরি তথ্য আদান প্রদান করার জন্য ব্রডব্যান্ড, ইন্টারনেট, টেলিফোন, পােস্ট অফিস, কুরিয়ার ইত্যাদির সুবিধা থাকা প্রয়োজন। যদি যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থা ভালো না হয় তাহলে কখনোই একটি পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন ও পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। এ জন্য যেখানে পরিবহন ও যােগাযােগ ব্যবস্থা ভালো রয়েছে রয়েছে সে স্থানে পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করা উচিত অথবা পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের কাজ শুরু করার পূর্বে সেস্থানে যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

স্থল পথে ট্রেনের মাধ্যমে পাওয়ার প্ল্যান্টে জ্বালানি সরবরাহ করা যায়।

3. মাটির কঠিনতা (Soil Strength):

বাষ্প বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষমতা অধিক হওয়ার কারণে অধিক সংখ্যক ইউনিট একত্র করলে মাটিতে কম্পনের সৃষ্টি হয় তাই বাষ্প বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের পাওয়ার হাউজ, বয়লার হাউজ প্রভৃতি নির্মাণ করতে মাটি অবশ্যই শক্ত হওয়া প্রয়োজন। আর্দ্র বা স্যাতসেতে মাটিতে কখনোই বাষ্প বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা উচিত নয়। কারণ এতে পাওয়ার প্ল্যান্ট ধীরে ধীরে মাটির নিচে বসে যেতে পারে অথবা বিধস্ত হয়ে যেতে পারে।

উপযুক্ত স্থানে পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন না করলে যে কোন সময় বিধস্ত হতে পারে

4. পানি সরবরাহের সুবিধা (Water Supply Facilities):

অন্যান্য শক্তি উৎপাদন কেন্দ্রের তুলনায় বাষ্প বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে পানির প্রয়োজন হয়। কারণ এখানে বয়লার ফিডের পানি, শীতলীকরণ পানি, প্ল্যান্টে কর্মরত কর্মচারী – শ্রমিকদের জন্য প্রয়ােজনীয় পানি এবং বিভিন্ন ধােয়া মােছার কাজে প্রচুর পরিমাণে পানি সরবরাহের প্রয়োজন হয়। তাই এ ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র বড় ধরনের পুকুর, জলাশয় এবং সারা বছর পানি থাকে এরুপ নদী তীরবর্তী এলাকা বা তার আশেপাশে স্থাপন করা উচিত। অন্যথায় দুরবর্তী স্থান হতে পাইপে সরবরাহকৃত পানির উপর ভরসা করে একটি পাওয়ার প্ল্যান্ট বেশি দিন চালানাে সম্ভব নয়। তবে কর্মরত কর্মচারীদের নিত্য প্রয়ােজনীয় পানির জন্য স্থানীয় শহর বা নিজস্ব পাম্পের পানি সরবরাহের উপর নির্ভর করা যেতে পারে।

5. শ্রমিকের প্রাচুর্য (Availability of Laborers): 

পাওয়ার প্ল্যান্টের বিভিন্ন কার্য পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিভিন্ন ধরনের শ্রমিক ও কর্মচারী প্রয়োজন হয়। তাই এটি এমন জায়গায় স্থাপন করা উচিত যেখানে স্বল্প ব্যয়ে প্রয়ােজনমতাে সকল ধরনের শ্রমিক ও কর্মচারী পাওয়া যাবে। এই প্ল্যান্টের খুচরা যন্ত্রাংশ ও অন্যন্য নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রাদি অপেক্ষাকৃত বেশি হওয়ায় এই প্ল্যান্টে অধিক সংখ্যক দক্ষ কর্মচারী শ্রমিক নিযুক্ত করা প্রয়োজন। এছাড়া দক্ষ জনশক্তির প্রাচুর্য থাকলে তাদের মধ্য থেকে কার্যোপযােগী সুদক্ষ কারিগর সংগ্রহ করা উচিৎ যা উৎপাদন কাজ সুষ্ঠভাবে চালাতে সাহায্য করবে।

6. যন্ত্রাংশের প্রাচুর্য (Availability of Equipment parts):

স্বাভাবিকভাবে প্ল্যান্টের কাজ চললে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ঘর্ষণে ঘর্ষণে ক্ষয় হতে থাকে এবং এক সময় যে কোন মূল্যবান যন্ত্রাংশ ভেঙ্গে বা অকেজো হয়ে যেতে পারে। এই অবস্থায় যাতে পার্শ্ববর্তী গ্যারেজ, হার্ডওয়্যার (Hardware)-এর দোকান বা পরিবহনের মাধ্যমে উক্ত যন্ত্রাংশ সুলভে পাওয়া যায় তার সুবিধা থাকা আবশ্যক।

7. শিল্প ও বাণিজ্যিক এলাকা (Industrial and Commercial areas):

বাষ্প বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র সাধারণত আকারে বড় হয় এবং এর বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাও অনেক বেশি হয়। বিদ্যুৎ সরবরাহের লাইন যত বড় হয় এর সার্বিক খরচ অর্থাৎ স্থাপন খরচ, মেরামত খরচ, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ ও লাইনে বিদ্যুৎ শক্তি অপচয়ের মাত্রাও ততো বাড়তে থাকে। যদি প্ল্যাণ্ট থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য নিকট বা আশেপাশে বড় ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে এরুপ স্থানে বাষ্প বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করা হয় সেক্ষেত্রে বিদ্যুৎ সরবরাহ ও বন্টন ব্যয় অনেক কম হবে যার ফলে গ্রাহকরাও কম খরচে বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারবে। তাই শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে এরুপ এলাকায় বাষ্প বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করা যুক্তি সঙ্গত।

8. বাজারের সুবিধা (Market Facility):

অদূরে বাজার রয়েছে এমন জায়গায় বাষ্প বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করা উচিৎ। এতে করে জরুরী মূহুর্তে প্রয়ােজন মােতাবেক খুচরা জ্বালানি, পিচ্ছিল কারক তেল, খুচরা যন্ত্রাংশ ইত্যাদি ক্রয় করার সুযোগ থাকে। এছাড়া বাজারে ভালাে ধরনের মেরামত কারখানা থাকলে সেখান থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অকেজো যন্ত্রাংশ মেরামত করে তা পূনরায় ব্যবহার উপযোগী করার সুবিধা থাকে। এছাড়াও পাওয়ার প্ল্যান্টের নিকটে বাজার থাকলে প্ল্যান্টে কর্মরত আবাসিক শ্রমিক কর্মচারীরা তাদের নিত্য প্রয়ােজনীয় পণ্য সামগ্রী ক্রয় করতে পারে।

9. জনবহুল অঞ্চল থেকে দূরে (Distance from populated area):

স্টিম পাওয়ার প্ল্যান্টে প্রচুর পরিমাণে কয়লা পোড়ানো হয় যার ফলে প্ল্যান্ট হতে অনবরত ধোঁয়া উৎপন্ন হয়। আর এই ধোঁয়া আশেপাশের অঞ্চলকে মারাত্বকভাবে দূষিত করে। তাই জনবহুল অঞ্চল, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশেপাশে বাষ্প বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা একেবারেই উচিত নয়।

পাওয়ার প্ল্যান্টের ধোঁয়া পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর

উপসংহার (Conclusion):

একটি স্টিম পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করতে গেলে উপরের সকল সুযোগ সুবিধা একসাথে পাওয়া যাবে না। তাই যেখানে পানি ও জ্বালানীর প্রাচুর্য রয়েছে যা জনবহুল অঞ্চল হতে কিছুটা দূরে এরুপ এলাকা বাছাই করা উচিত। এক্ষেত্রে নদীর পার্শ্ববর্তী এমন একটি এলাকা বাছাই করা উচিত যেখানে সারাবছর পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায়, বায়ুমণ্ডলের কোন দূষণ হয় না এবং জ্বালানী পরিবহন করার ব্যবস্থা রয়েছে। সম্ভবত স্টিম পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য এটি একটি আদর্শ পছন্দ হতে পারে।

References:

Principles of Power system by V. K. Metha & Rohit Metha

Electrical 4u

Wikipedia

অন্যান্য লেখাসমূহ

স্টিম পাওয়ার প্ল্যান্টের সংজ্ঞা, প্রকারভেদ, উপাদান ও প্রাথমিক ধারণা সম্বন্ধে পড়ুন।

পাওয়ার প্ল্যান্ট: সংজ্ঞা, প্রকারভেদ ও কার্যপদ্ধতি সম্বন্ধে পড়ুন।

পাওয়ার প্লান্টে টারবাইন নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্বন্ধে পড়ুন।

প্রাইম মুভারঃ সংজ্ঞা, প্রকারভেদ, ব্যাখা ও টারবাইন সম্বন্ধে আলোচনা।