নামটা শুনেই আন্দাজ করতে পারছেন আজকের টপিকটি বেশ মজাদার হতে চলেছে। ইলেকট্রিক্যাল এমন একটি বিষয় যেটার সাথে বাস্তব জীবনের গল্পগুলো পুরোপুরি মিলে যায়। আজকে এক বিলাসী বউ ও দুর্ভাগা জামাইয়ের গল্প শুনাব আপনাদের।
পাওয়ার ফ্যাক্টর মামা ও ইন্ডাক্টর মামী
আমার এক বন্ধুর নাম ভোল্টেজ। তার মামা নতুন বিয়ে করেছে। মামা খুবই মজার মানুষ। মামার নাম পাওয়ার ফ্যাক্টর। মামীর নাম ইন্ডাক্টর। ইন্ডাক্টর মামী খুব বিলাসিতা করে। সারাদিন মামাকে গয়না আর শাড়ির জন্য বায়না করে। মামাও এদিকে টাকা খরচ করতে করতে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। নতুন বউ বলে কথা। কিছু বলতেও পারছেনা। শুধু তাই নয় মামী বেশ কুটবুদ্ধিসম্পন্ন। চক্রান্ত করে আমার বন্ধু ভোল্টেজ ও তার বউ কারেন্টের এর মধ্যে বিরহ সৃষ্টি করার চেষ্টা করে।
গল্পটি বেশ মজার হলেও এই মজার গল্পে লুকিয়ে আছে আমাদের ইলেকট্রিক্যাল প্রকৌশল জগতের এক বাস্তবতা। আর সেটি হল পাওয়ার ফ্যাক্টর এবং বিদ্যুৎ বিলের সম্পর্ক। এই গল্পটি মূলত এই বিষয়টিকে তুলে ধরার জন্যই বলা হয়েছে। চলুন গল্পের সাথে এই কারিগরি জটিল বিষয়টিকে তুলনা করে আজকের আড্ডাটা জমিয়ে তুলি।
ইন্ড্রাস্ট্রিতে আমরা যেসমস্ত লোড ব্যবহার করি তার অধিকাংশই ইন্ডাক্টিভ লোড। সোজা কথায়, এমন কিছু ডিভাইস যেগুলোতে ইন্ডাক্টর বিদ্যমান। এই ইন্ডাক্টর মামী কিন্তু একদম সুবিধার না। আগেই বলা হয়েছে ইন্ডাক্টর মামী আমার বন্ধু ভোল্টেজ এবং তার বউ কারেন্টের মাঝে বিরহ তৈরি করার চেষ্টা করে।
আর বউয়ের এই কাজের জন্য ভাগিনার কাছে পাওয়ার ফ্যাক্টর মামার সম্মান কমে যায়। কারিগরি জটিল ভাষায়, বললে ইন্ড্রাস্টিতে ইন্ডাক্টিভ লোড বেশি হবার দরুণ ভোল্টেজ এবং কারেন্ট ল্যাগিং কন্ডিশনে থাকে। অর্থাৎ ভোল্টেজ ও কারেন্টের মধ্যবর্তী ফেজ এংগেল বেড়ে যায়। যেমনটি ভোল্টেজ ও তার বউ এর মধ্যে বিরহ সৃষ্টি হয়েছিল। ফলশ্রুতিতে পাওয়ার ফ্যাক্টরের মান কমে যায়। যেমনটা ভাগিনার কাছে মামার সম্মান কমে গিয়েছিল।
কারণ আমরা জানি, পাওয়ার ফ্যাক্টর হল ভোল্টেজ এবং কারেন্টের মধ্যবর্তী ফেজ এংগেলের কোসাইন মান। ফেজ এংগেল বেড়ে গেলে এই কোসাইন মান তথা পাওয়ার ফ্যাক্টর কমে যাবে। এতো গেল ইন্ডাক্টর মামীর কুচক্রী মনোভাবের গল্প। এবার আমরা তার বিলাসিতার কথা জানব।
পাওয়ার ফ্যাক্টর কমে গেলে কোম্পানিকে বাড়তি বিদ্যুৎ বিলের হিসেব পোহাতে হয়। যেমনটা ইন্ডাক্টর মামীর জন্য মামাকে প্রচুর অর্থ খরচ করতে হয়েছে। সেই সাথে “পেনাল্টি চার্জ” ত আছেই।
পেনাল্টি চার্জ কি?
কোন কোম্পানি যদি আদর্শ পাওয়ার ফ্যাক্টরের মান (সাধারণত 0.98) বজায় রাখতে না পারে তাহলে সংশ্লিষ্ট পাওয়ার সাপ্লাই কোম্পানিকে তাদের জরিমানা দিতে হয়। এই জরিমানাকেই বলা হয় পেনাল্টি চার্জ।
এবার আমরা গাণিতিকভাবে বুঝব কিভাবে ইন্ডাক্টর মামীর বিলাসিতার দরুণ পাওয়ার ফ্যাক্টর মামা তথা কোম্পানির বেহাল দশা হয়?
এসি সিস্টেমে তড়িৎক্ষমতা (P), বিভব (V) এবং তড়িৎ প্রবাহ (I) এর সাথে নিম্নোক্তভাবে সম্পর্কিত
P=V×I×cosθ…….(1)
এখানে θ হল Phasor Domain এ বিভব ও তড়িৎ প্রবাহ নির্দেশকারী ভেক্টরের মধ্যবর্তী কোণ। (ডিসি সিস্টেমে θ=0 তাই P=V×IP=V×I)। এর কোসাইন হলো সিস্টেমের পাওয়ার ফ্যাক্টর। V×I রাশিটিকে Apparent power বা kVA রেটিং বলা হয় যাকে S দ্বারা প্রকাশ করা হয়। সাধারণত যন্ত্রের ক্ষমতার পরিমাপ করা হয় এই kVA রেটিং দ্বারা।
সারাংশ হল, V×I=S এবং cosθ=P.F
এবার কোনো একটি সিস্টেমের পাওয়ার ফ্যাক্টর যদি কম হয়, তবে ঠিক একই পরিমাণ ক্ষমতা (P) পেতে হলে আপনাকে বেশী kVA রেটিং এর যন্ত্রের প্রয়োজন হবে। কারণ, (১) নং সমীকরণ বলে যে,
S=P/P.F
যে যন্ত্রের kVA রেটিং বেশী, সেটি বেশি ব্যয়বহুল। অর্থাৎ খরচ বেড়ে যাবে।
আর যদি আপনি একই যন্ত্র ব্যবহার করে থাকেন (অর্থাৎ S এবার fixed) তাহলে নিম্ন পাওয়ার ফ্যাক্টরের কারণে আপনার Active power বা কার্যকর ক্ষমতা (P) কমে যাবে। কারণ,
P=S×P.F
আপনার বাসায় পাওয়ার ফ্যাক্টর এর মান বেশি কমে গেলে বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রতিষ্ঠান জরিমানা করতে পারে। কারণ নিম্ন মানের পাওয়ার ফ্যাক্টরের ক্ষমতা সরবরাহ করলে সরবরাহ লাইনের তড়িৎ প্রবাহ বেড়ে যায়।
কিভাবে?
১নং সমীকরণে ফিরে আসি। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আপনার বাসায় সর্বদা একটি নির্দিষ্ট বিভবে বিদ্যুৎ দিয়ে থাকে। আমাদের উপমহাদেশের জন্য এর মান ২২০/২৩০ ভোল্ট। আমাদের ব্যবহার্য যন্ত্রপাতিগুলো এই বিভবের জন্য উপযোগী করেই তেরি করা। তাই V সর্বদা স্থির রাখতে হবে। আপনি যদি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ক্ষমতা (P) নিয়ে থাকেন, তবে পাওয়ার ফ্যাক্টর কম হলে তড়িৎপ্রবাহের মান বেড়ে যাবে।
P=VxI×P.F
আর তড়িৎ প্রবাহ বেশী হলে সিস্টেম লস অর্থাৎ সরবরাহ লাইনে বিদ্যুতের অপচয় হবে (Ploss=I2×R) । অধিক বিদ্যুৎ পরিবহনের জন্য তারের পুরুত্ব বাড়াতে হবে। এতে খরচ বেড়ে যায়। একারণে বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা আপনাকে চার্জ করতে পারে। দেখলেন ত ইন্ডাক্টর মামীর বিলাসিতা পাওয়ার ফ্যাক্টর মামা তথা কোম্পানির পকেট ত খালি করল বটে সেই সাথে ভাগিনার কাছে সম্মানও কমিয়ে দিল। এই ছিল পাওয়ার ফ্যাক্টর নামের দুর্ভাগা মামার গল্প।
পাওয়ার ফ্যাক্টর নিয়ে আরো কিছু পোস্ট
সহজ ভাষায় পাওয়ার ফ্যাক্টর নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা ও প্রশ্ন-উত্তর
PFI – Power Factor Improvement | পাওয়ার ফ্যাক্টর ইমপ্রুভমেন্ট ও ক্যালকুলেশন