পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান জ্বালানী হচ্ছে ইউরেনিয়াম। দেখা গেছে যে, ৪৫০০ (চার হাজার পাঁচশত) টন উচ্চ গ্রেডের কয়লা থেকে যে পরিমাণ শক্তি পাওয়া যায় সেই একই পরিমাণ শক্তি মাত্র ১ কেজি ইউরেনিয়াম ( U-235) থেকে পাওয়া যায়। আজকের আলোচনায় আমরা এই ইউরেনিয়াম সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য জানবঃ
- ইউরেনিয়াম কি ?
- ইউরেনিয়ামের উপাদান।
- পারমাণবিক শক্তির জন্য জ্বালানী তৈরীতে কেন শুধু ইউরেনিয়ামই ব্যবহৃত হয়?
- ইউরেনিয়ামের প্রাপ্তিস্থান।
- ইউরেনিয়াম থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন (ভিডিও)।
ইউরেনিয়াম কি ?
ইউরেনিয়াম একটি তেজস্ক্রিয় ধাতু ও উচ্চ ঘনত্বের মৌল। ১৭৮৯ সালে বিজ্ঞানী মার্টিন হাইনরিখ ক্লাপরথ (Martin Heinrich Klaproth) ইউরেনিয়াম আবিষ্কার করেছিলেন। ধারণা করা হয় যে, তখনকার সবচেয়ে সাম্প্রতিক ঘটনা ছিলো ইউরেনাস গ্রহের আবিষ্কার এবং তিনি তখন এই ইউরেনাস গ্রহের নামানুসারেই তার আবিষ্কৃত মৌলের নাম রেখেছিলেন ইউরেনিয়াম। ১৮৯৬ সালে বিজ্ঞানী হেনরি বেকেরেল (Henri Becquerel) সর্বপ্রথম ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার করেন।
ইউরেনিয়াম পর্যায় সারণীর ৯২ তম মৌল এবং পর্যায় সারণীর ৭ম পর্যায়ের ৩য় শ্রেণির B উপশ্রেণিতে অবস্থিত। এটি দেখতে নীলচে সাদা বর্ণের ও স্টীল থেকে কিছুটা নরম। তবে যখন এটি পরিশোধন করা হয় তখন এর বর্ণ সোনালী সাদা থাকে।
ইউরেনিয়ামের উপাদানঃ
বিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম মৌলে ইউরেনিয়াম – ২৩৫ (U-235) ও ইউরেনিয়াম -২৩৮ (U-238) নামে দুইটি আইসোটোপ আছে। ইউরেনিয়ামে দুইটি আইসোটোপ পাওয়া গেলেও ইউরেনিয়াম – ২৩৫ (U-235) এর পরিমাণ খুবই নগন্য। এর নিউক্লিয়াসে ৯২ টি প্রোটন ও ১৪৬ টি নিউট্রন রয়েছে। অপরদিকে ইউরেনিয়াম – ২৩৫ এর নিউক্লিয়াসে ৯২টি প্রোটন ও ১৪৩টি নিউট্রন রয়েছে।
তবে প্রাকৃতিক ইউরেনিয়ামে তিনটি আইসােটোপের মিশ্রণ রয়েছেঃ ইউরেনিয়াম -২৩৮, ইউরেনিয়াম -২৩৫ এবং ইউরেনিয়াম -২৩৪।
এসব প্রাকৃতিক ইউরিনিয়ামে-
ইউরেনিয়াম- ২৩৮ | ৯৯.২৮২% |
ইউরেনিয়াম -২৩৫ | ০.৭১২% |
ইউরেনিয়াম -২৩৪ | ০.০০৬% |
প্রকৃতি হতে ভারী ইউরেনিয়াম সংগ্রহ করে পরীক্ষা করলে দেখা যায় যে, এর মধ্যে সমপরিমাণ তামা (copper) ও সীসা (lead) রয়েছে। এছাড়া এতে শক্ত নিকেল ও সাদা ধাতুর (white metal) কিছু গুণাগুণও লক্ষ্য করা যায়।
পারমাণবিক শক্তির জন্য জ্বালানী তৈরীতে কেন শুধু ইউরেনিয়ামই ব্যবহৃত হয়?
প্রাকৃতিক ইউরেনিয়ামের উপাদন সমূহের মধ্যে শুধু ইউরেনিয়াম -২৩৫ চেইন বিক্রিয়া (chain reaction) ঘটায় এবং খণ্ড-বিখন্ডিত হয়। কিছু পরিমাণ ইউরেনিয়াম -২৩৮ খণ্ড-বিখন্ডিত হলেও এরা কোন বিভাজন (fission) ঘটায় না।।
পারমাণবিক চুল্লিতে জ্বালানি হিসেবে মূলত ইউরেনিয়াম এর ০.৩% অক্সাইড আকরিক ধাতু ব্যবহার করা হয়। এই অক্সাইড আকরিক ধাতু ইউরেনিয়াম -২৩৫ (U-235) এবং ইউরেনিয়াম -২৩৮ (U-238) এর সংমিশ্রণে উৎপন্ন করা হয়।
বিশ্বে আর কোনও পদার্থের মৌলে এই বিভাজনের জন্য উপযুক্ত আইসােটোপ পাওয়া যায় নি। তবে এই ধরনের বৈশিষ্ট্য আরও কয়েকটি পারমাণবিক পদার্থের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়, যেমনঃ ইউরেনিয়াম -২৩৩, প্লুটোনিয়াম -২৩৯। কিন্তু এসকল পদার্থ প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না, শুধু কৃত্রিম উপায়ে পারমাণবিক চুল্লিতে সেগুলাে পাওয়া যেতে পারে। মূলত এই কারণেই পারমাণবিক শক্তির জন্য জ্বালানি তৈরীতে শুধুমাত্র ইউরেনিয়াম ব্যবহার করা হয়।
ইউরেনিয়ামের প্রাপ্তিস্থানঃ
পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগেই ইউরেনিয়ামের গড় ঘনত্ব অনেক বেশী প্রায় ৩x১০^-৪ %। এটা ঘনত্ব রূপা ও স্বর্ণের ঘনত্ত্বের যথাক্রমে ৩০ গুণ ও ১০০০ গুণের মতো বেশী। সাধারণত পৃথিবীর উপরিভাগের ২০ কিলােমিটারের স্তরে প্রায় ১,০১৪ টন ইউরেনিয়াম রয়েছে। অবশ্য ইউরেনিয়ামের বিক্ষিপ্ত উপাদানের মধ্যে পড়ে এর কম অংশই ভূগর্ভস্তরে সঞ্চিত আছে যাতে প্রায় ০.৩% এর কিছু বেশী ইউরেনিয়াম থাকতে পারে। তা সত্ত্বেও প্রথম দিকে ইউরেনিয়াম উত্তোলন করা হতাে উন্নত মানের খনি থেকে। এইরকম কঙ্গোর (বর্তমানে রিপাব্লিক অফ জাইর) পিচব্লেণ্ড (pitchblende- যা পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছে) তাতে ৬৫% (ওজনের দিক থেকে) পর্যন্ত পরিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম ডাই অক্সাউড থাকতাে। বর্তমান প্রযুক্তি ব্যবহার করে সমুদ্রের জল থেকে ইউরেনিয়াম আহরণে প্রতি কেজিতে প্রায় ৭৫০ মার্কিন ডলার খরচ পড়বে যার অদূর ভবিষ্যতে তেমন কোন অর্থনৈতিক সাফল্যের সম্ভাবনা নেই।
যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, কঙ্গো, কলোরাডে, মেক্সিকো, আলাস্কা, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইডেন, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, ব্রাজিল, চিলি, ডারউইন প্রভৃতি স্থানে ইউরেনিয়ামের খনি রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত সংলগ্ন মেঘালয় প্রদেশে একটি অসম্পূর্ণ ইউরেনিয়ামের খনি পাওয়া গেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় ২,৪৫,০০,০০০ টন এর বেশি ইউরেনিয়াম রয়েছে। পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহে মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন, জাপান, ভারত প্রভৃতি দেশ পারমাণবিক শক্তিতে এগিয়ে রয়েছে।
বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম ধাতুর কোন খনি আবিষ্কৃত হয় নি। তবে সিলেট ও মৌলভীবাজারের ভূগর্ভের মাটির স্তরে এ ধাতুটির উপস্থিতি রয়েছে বলে জানা গেছে।
যেভাবে ইউরেনিয়ামকে ব্যবহার করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় দেখুন ভিডিওটিতে:
References:
Rooppurnpp, Wikipedia & text books
পাওয়ার প্ল্যান্ট সম্বন্ধে অন্যান্য লেখাসমূহঃ
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
বাষ্প বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্বন্ধে আলোচনা।
পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইতিহাস ও সংক্ষিপ্ত আলোচনা।
পাওয়ার প্ল্যান্টঃ সংজ্ঞা, প্রকারভেদ ও কার্যপদ্ধতি।