লোডশেডিং কি / Load shedding: আমাদের জনসাধারণের মনে একটা সাধারণ ধারণা বিরাজ করে ‘বিদ্যুৎ চলে যাওয়া মানেই লোডশেডিং হয়েছে। বাস্তবিকভাবে ব্যাপারটা কি তাই? চলুন জনসাধারণের ধারণা ও কারিগরি বাস্তবতার আলোকে আজ আলোচনা করব।
লোডশেডিং বলতে কি বুঝায়?
ধরুন, আপনি আপনার জন্মদিন খুব জাকজমকভাবে পালন করবেন। আপনার পরিচিতদের মধ্য থেকে ৫০ জন মানুষকে দাওয়াত করলেন। ঐতিহ্যবাহী সুলতান ডাইন থেকে ৫০ প্যাকেট কাচ্চি বিরিয়ানি পার্সেল করে আনলেন। কিন্তু পরে দেখা গেল যে ৫০ জনকে দাওয়াত করলেন তাদের প্রত্যেক ই সাথে করে একজন অতিথিকে নিয়ে আসলেন। তাহলে অতিথির সংখ্যা দাড়াল ১০০ জন। কিন্তু আপনার কাছে আছে ৫০ প্যাকেট বিরিয়ানি। তাই আপনি একটা প্যাকেটকে ১ঃ২ করে ভাগ করে সবার মাঝে পরিবেশন করলেন। এখানে চাহিদা ছিল ১০০ প্যাকেট কাচ্চি বিরানির কিন্তু আপনার কাছে ছিল ৫০ প্যাকেট। কিন্তু আপনি কাউকে অভুক্ত রাখেননি।
৫০ প্যাকেট ই সবার মাঝে ভাগ করে দিয়েছেন। কিন্তু ঘাটতি এক জায়গায় রয়ে গেল সেটা হল তৃপ্তি নিয়ে সবাই খেতে পারল না। লোডশেডিং এর দৃশ্যপট টাও ঠিক এরকমই। দেশের ২৪ ঘন্টায় বিদ্যুৎ এর চাহিদা আর উৎপাদন একই নাও হতে পারে। যখন বিদ্যুৎ চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হয় তখন বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো বাড়তি চাপ হ্রাসের জন্য মাঝে মধ্যে এক এলাকার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে অন্য এলাকায় বিতরণ করে। আর এই প্রক্রিয়াকে বলে লোডশেডিং।
বাংলাদেশে এখন লোডশেডিং নেই বললেই চলে। একটা সময় আমাদের প্রচুর লোডশেডিং হতো। এমন দিনও গিয়েছে হয়তো পুরো রাত বাড়ির ছাদেই কাটাতে হয়েছে কিংবা উঠোনে। বর্তমানে আমাদের দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৩,৫৪৮ মেগাওয়াট, এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন এ সর্বোচ্চ চাহিদা ১২,০০০ মেগাওয়াট যা উৎপাদন ক্ষমতার তুলনায় অনেক কম। ২০২৩ সালের মধ্যে সরকার বিদ্যুৎ ক্ষমতা বর্ধিত করে ২৮,০০০ মেগাওয়াট এ উত্তীর্ণ করার প্রকল্প গ্রহণ করতে যাচ্ছে। তাই লোডশেডিং বহুলাংশে কমে এসেছে এখন।
বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার ক্ষেত্রে কারিগরি বাস্তবতা
সিস্টেম লস
আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে উন্নতি সাধিত হয়েছে। কিন্তু এর পরেও বিদ্যুৎ আসা যাওয়া লেগেই থাকে কারণ আমাদের বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা এখনো এতটা উন্নত নয়। একটি উদাহরণ দিয়ে বুঝানো যাক। মনে করুন, আপনাকে ১০০ টি আপেল ১০০ জনকে বিতরণ এর দায়িত্ব দেয়া হল। এখন আপনি ৩০ টি আপেল বিক্রি করে দিলেন, ২০ টি আপেল পচে গেল। এখন বাকি ৫০ টি আপেল নিশ্চয়ই আপনি ১০০ জনের মধ্যে সুষ্ঠভাবে বিতরণ করতে ব্যর্থ হবেন। অর্থাৎ যে ব্যাপারটি দাড়াল, আপেল চাষী আপনাকে ঠিক ই ১০০ জনের জন্য জনপ্রতি একটি করেই আপেল দিল কিন্তু আপনি গ্রাহক পর্যন্ত পৌছাতে ব্যর্থ হলেন।
আমাদের বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থাতেও এরকম নানা ত্রুটির কারণে গ্রাহকদের এখনো ভোগান্তি হচ্ছে। এর কিছু কারণ আলোচনা করা হল সিস্টেম লস।
উপরের উদাহরণটিতে কিছু আপেল পচে যাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। এটি মূলত সিস্টেম লসকেই ইংগিত করছে।
এই সিস্টেম লসের দরুণ গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ বিতরণে সমস্যার সৃষ্টি হয়। পরিবাহীর লাইন রেজিট্যান্স বৃদ্ধি, পাওয়ার ফ্যাক্টর হ্রাস সিস্টেম লসের অন্যতম কারণ।
সিনক্রোনাইজেশনের অভাব
সঠিক সিনক্রোনাইজিং এর অভাব: সিনক্রোনাইজিং হল উপকেন্দ্র গুলোর মধ্যে পাওয়ার ফ্যাক্টর, ফেইজ শিফট, ফ্রিকুয়েন্সি, পোলারাইজেশান ইনডেক্স প্রভৃতি প্যারামিটারের সামঞ্জস্যতা থাকা।
বর্তমানে বাংলাদেশে অধিকাংশ সাবস্টেশান ই এনালগ। বিশেষ করে পল্লী অঞ্চলে এখনো বিদ্যুৎ বিতরণে আধুনিকায়ন হয়নি।
ফলে উপকেন্দ্র গুলোর মধ্যে সিনক্রোনাইজিং এর অভাব দেখা যায়। ফলে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। স্মার্ট গ্রীড সিস্টেম ই পারে এই ঝামেলা দূর করতে।
আন্ডারগ্রাউন্ড পাওয়ার লাইন এর অভাব
আমাদের দেশে বেশিরভাগ ই ওভারহেড পাওয়ার লাইন। সেই কারণে ঝড়, বৃষ্টি, গাছপালা পড়ে লাইন ফল্ট সৃষ্টি হয়।
পল্লী অঞ্চলে গাছপালা বেশি হওয়ায় ঝড়ো বাতাসে ফল্ট ও দেখা যায় বেশি।
ত্রুটিপূর্ণ ডিভাইস স্থাপন
অনেক সময় বিদ্যুৎ কোম্পানির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো অধিক মুনাফার লোভে ত্রুটিপূর্ণ ডিভাইস, পোলে স্থাপন করে।
যার দরুন ডিভাইসে ঘন ঘন ফল্ট দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে নৈতিক দিকটি অবশ্যই বিবেচনায় রাখা উচিত
অবৈধ সংযোগ
বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো নীতিভ্রষ্ট হয়ে বিভিন্ন লাইসেন্সবিহীন অবৈধ সংযোগ দিয়ে থাকে। উপরে উল্লেখিত উদাহরণে আপেল বিক্রির ঘটনাটি তার ই ইংগিত বহন করে৷
যার দরুণ বিদ্যুৎ বিতরণে বিভ্রাট ঘটে। নৈতিকতা ও জবাবদিহিতার দিকটি স্বচ্ছ হলে এমন সমস্যা সহজেই দূরীভূত হবে।
বাৎসরিক কমিশনিং এবং রক্ষণাবেক্ষণে গাফলতি
সাধারণত প্রতি বছর শেষে সাবস্টেশান এবং পোল ইকুইপমেন্ট গুলো কমিশনিং এবং রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়।
কমিশনিং বলতে বোঝায় সাবস্টেশান ও লোকাল পোল গুলোর ইকুইপমেন্ট কতটুকু কার্যকরী অবস্থায় আছে তা তদন্ত করা এবং কার্যকরী না হলে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা। কমিশনিং-এর পর সরেজমিন রিপোর্ট কর্তৃপক্ষের নিকট জমা দিতে হয়।
কর্তৃপক্ষ পরিকল্পনামাফিক রক্ষণাবেক্ষণ এর জন্য কারিগরি টিমকে দায়িত্ব প্রদান করে। কিন্তু এসব গুরুদায়িত্বের ক্ষেত্রে অনেক সময় দায়িত্বরতদের গাফিলতি পরিলক্ষিত হয়।
লোডশেডিং আর ত্রুটিপূর্ণ বিতরণ ব্যবস্থাকে ঘুলিয়ে ফেলার কোন মানে নেই। নানা ফল্ট এর দরুণ বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটে।
কখনো কখনো যাওয়ার এক দুই সেকেন্ডের মধ্যেও বিদ্যুৎ চলে আসার অভিজ্ঞতা অনেকের ই আছে। এটা সাধারণত সূক্ষ ফল্ট এর বেলায় ঘটে।
উদাহরণস্বরুপ ডিস্ট্রিবিউশান লাইনে কোন কারণে লাইন টেনশান বেড়ে যাওয়া। এরকম ফল্ট গুলো অটোরিক্লোজার খুব অল্প সময়ে ডিটেক্ট করতে পারে।
অটোরিক্লোজার কি?
মডার্ন সাবস্টেশনে উচ্চ ভোল্টেজ, উচ্চ লোড কারেন্ট-এ রেটিং করা, SCADA প্রযুক্তিতে পরিচালিত, স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফল্ট ডিটেক্ট করার জন্য যে সুইচগিয়ার প্রটেকশন থাকে তাকে অটোরিক্লোজার বলে।
বাংলাদেশের ডিস্ট্রিবিউশান সিস্টেম নিয়ে কিছু পোস্ট:
ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন দুই বন্ধুর পথ যাত্রার এক মজার কাহিনী