মনে করুন, সময়টা বর্ষাকাল। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। বাসায় বসে ছোট ভাইয়ের সাথে লুডু খেলছেন। ভাবলেন আজ দুপুরের খাবারে যদি কাচ্চি বিরিয়ানি হয় ব্যাপারটা বেশ জমে যাবে। তাই ছাতা নিয়ে বাজারে গেলেন কাচ্চির জন্য খাসির মাংস এবং বাসমতি চাল কিনতে। রাস্তা দিয়ে চলার সময় আকস্মিকভাবে সম্মুখীন হলেন বজ্রপাতের। খুব চমকে উঠলেন আর সেই সাথে কৌতূহলী মনে প্রশ্ন জেগে উঠল কিভাবে এই বজ্রপাত সৃষ্টি হল এবং বজ্রপাত এসি নাকি ডিসি সিগন্যাল? চলুন আজ আপনার এই কৌতূহল অবসান ঘটানোর চেষ্টা করি।
বজ্রপাত কি?
বজ্রপাত বলতে আকাশের আলোর ঝলকানিকে বুঝায়। আমরা জানি মেঘমালা বৈদ্যুতিক আধান বহন করে। আর মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলেই এই ঘটনার উদ্ভব হয়। এই বৈদ্যুতিক ঘটনা দুটো মেঘের মধ্যে অথবা একটি মেঘ এবং ভূমির মধ্যেও হতে পারে।
এই সময় উক্ত এলাকার বাতাসের প্রসারন এবং সংকোচনের ফলে আমরা বিকট শব্দ শুনতে পাই।
বজ্রপাত নিয়ে চমকে যাওয়ার মত পরিসংখ্যান
পৃথিবীপৃষ্ঠের কোথাও না কোথাও প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৪৪ বার বজ্রপাত ঘটছে, বছরশেষে গড়ে এই সংখ্যাটা প্রায় ১৪০০ মিলিয়নে গিয়ে দাঁড়ায়।
আর বাংলাদেশের সিলেটের সুনামগঞ্জে তিন মাসে প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় ২৬টি বজ্রপাত আঘাত হানে। বজ্রপাত সম্পর্কিত এই পরিসংখ্যান সত্যিই চমকে দেয়ার মত।
বজ্রপাত সৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় উপাদান
বজ্রপাত সৃষ্টির জন্য সাধারণত তিনটি উপাদান ভূমিকা রাখে। যথাঃ
- আর্দ্রতা, যেটি মেঘ এবং বৃষ্টির সৃষ্টি করে।
- দ্বিতীয়টি অস্থির বায়ু যেটি উষ্ণ বা গরম বায়ুকে দ্রুত বায়ুমন্ডলের উপরের স্তরে নিয়ে যায়।
- তৃতীয়টি লিফট বা উত্তোলনে সাহায্যকারী, যেটি শীতল বা উষ্ণ ফ্রন্ট, সমুদ্রের বায়ু কিংবা পাহাড় বা সূর্য থেকে আসা উত্তাপকে বজ্রপাত সৃষ্টির কাজে সাহায্য করে।
ফ্রন্ট কি?
ফ্রন্ট হচ্ছে বায়ুমন্ডলের মধ্যে এমন একটি এলাকা যেখানে দুটি ভিন্ন অবস্থায় থাকা বায়ু রূপান্তরিত হতে পারে।
বজ্রপাত সৃষ্টির ধাপসমূহ
প্রথম ধাপ: কিউম্যুলাস মেঘের পরিচলন
আকাশে সাধারণত চার ধরনের মেঘ দেখা যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত ধরনটি হচ্ছে স্তুপাকার বা কিউম্যুলাস (Cumulus) মেঘ। এই কিউম্যুলাস মেঘ খন্ড খন্ড অংশে আকাশে ভেসে বেড়ায়। কখনও বা খন্ডগুলো একত্রিত হয়ে আকাশের দীর্ঘ এলাকাজুড়ে তাদের বিস্তার ঘটায়। এই কিউম্যুলাস মেঘের সৃষ্টি হয় তাপের পরিচলন প্রক্রিয়ায়। এই মেঘ দেখতে অনেকটা ফুলকপির মতো। সচরাচর রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশে দেখা যায় এদের। এদের বিস্তার ভূমির প্রায় ৪০০০ ফুট উচ্চতার মধ্যে। কখনও এটি ২০ হাজার ফুট উচ্চতায়ও উঠতে পারে। এই মেঘের নিচের অংশ কিছুটা কালচে হলেও সূর্যের আলো পেয়ে উপরের অংশ উজ্জ্বল সাদা দেখায়। এই সময়ে যদি অল্প পরিমাণ বৃষ্টিও হয়, সেক্ষেত্রে বৃষ্টির সাথে মাঝে মাঝে বজ্রপাতের দেখা মেলে।
পরিচলন কী ?
কোনো তরল ও বায়বীয় পদার্থের মধ্য দিয়ে যে পদ্ধতিতে তাপ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হয় তাকেই সহজ ভাষায় পরিচলন বলে।
এই পদ্ধতিতে পদার্থের অণুগুলোর চলাচলের দ্বারা তাপের স্থানান্তর ঘটে।
যেভাবে আলোর ঝলকানির সৃষ্টি হয়
ব্যাটারির ন্যায় পোলারিটির সৃষ্টি
শীতল বায়ুতে বরফের স্ফটিক বা ক্রিস্টালের দেখা মেলে। এই বরফের স্ফটিক তৈরি হয় শীতল পানির সংকোচনের মাধ্যমে। একইভাবে উষ্ণ বায়ুতে থাকে পানির কণা বা ড্রপলেট। ঝড়ের তীব্রতার ফলে এই বরফের স্ফটিক ও পানির কণার মাঝে সংঘর্ষ হয় এবং তারা ছিটকে সরে যায়। এই অবস্থায় মেঘে স্থির বৈদ্যুতিক চার্জ সৃষ্টি হয়। এই ব্যাপারটিকে তুলনা করা যেতে পারে ব্যাটারির সাথে। ব্যাটারির যেমন ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক অংশ থাকে, তেমনি এই মেঘে সৃষ্টি হওয়া বৈদ্যুতিক অবস্থাটিরও থাকে এমন দুটি অংশ। ধনাত্মক অংশটি থাকে মেঘের শীর্ষদেশ অর্থাৎ উপরিভাগ জুড়ে। আর ঋণাত্মক অংশটি থাকে মেঘের নীচের অংশ জুড়ে। নীচের অংশ জুড়ে পর্যাপ্ত ঋণাত্মক চার্জ বাতাসে ভেসে বেড়ায় এবং বিপরীত চার্জে চার্জিত বস্তুর দিকে এগিয়ে যায়। বজ্রপাতের এই শক্তির একটি নামও আছে, লিডার স্ট্রোক। এটি শক্তিশালী রূপ নিয়েই ভূমিতে আঘাত হানতে পারে, কারণ ভূমি হচ্ছে বিপরীত অর্থাৎ ধনাত্মক চার্জযুক্ত।
স্টিপেড লিডার চ্যানেল তৈরি হওয়া
দুই বিপরীতমুখী চার্জ মিলিত বা সংঘর্ষ হওয়ার আগে এদের মধ্যে চলাচলের একটি মাধ্যম প্রয়োজন হয়।বাতাসে থাকা ঋণাত্মক চার্জ ও ভূমিতে থাকা ধনাত্মক চার্জের মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গায় ভোল্টেজ বা বিভব পার্থক্যের সৃষ্টি হয়। এই বিভব পার্থক্য যথেষ্ট শক্তি অর্জন করা সাপেক্ষে তড়িৎ পরিবাহিতার সৃষ্টি করে। এই সময় স্টিপেড লিডার নামে একটি রুট বা চ্যানেল গঠিত হয়। এই স্টিপেড লিডার হচ্ছে একটি স্বল্প বা অনুজ্জ্বল আলোর রেখা যা বজ্রপাতের সময় মেঘের নীচের অংশ থেকে ভূ-পৃষ্ঠের দিকে নেমে আসে। ভূ-পৃষ্ঠের কাছাকাছি গেলে এর সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য মাটির ধনাত্মক চার্জ উপরের দিকে তাপের প্রবাহ সরবরাহ করে। এটিই পথ দেখায় ঋণাত্মক চার্জের ইলেকট্রনকে মাটির ধনাত্মক চার্জের কাছে আসতে। এটি অবশ্য খালি চোখে দেখা যায় না।
দ্বিতীয় ধাপঃ বায়ুর উর্ধ্বমুখী প্রবাহ এবং নিম্নমুখী প্রবাহ
এই ধাপে মেঘগুলো ৪০ হাজার থেকে ৬০ হাজার ফুট অর্থাৎ আরও উচ্চতায় উঠতে থাকে তাপের পরিচলনে।ঝড় বা বৃষ্টির সময়কালে মেঘের এই স্থানগুলোয় বায়ুর উর্ধ্বমুখী প্রবাহ এবং নিম্নমুখী প্রবাহ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। একইসাথে এই দুই প্রবাহের শক্তিশালী হয়ে ওঠা বজ্রপাতকেও শক্তিশালী করে তোলে। বায়ুপ্রবাহের এই তারতম্য বজ্রপাতের সৃষ্টিতে মূল ভূমিকা রাখে।
শেষ ধাপঃ বায়ুর উর্ধ্বমুখী প্রবাহ কমে যাওয়া
এই ধাপে বায়ুর উর্ধ্বমুখী প্রবাহ কমে যাওয়ায় লাগাম টেনে ধরার সুযোগ পায় নিম্নমুখী প্রবাহের শক্তি। স্থির বৈদ্যুতিক চার্জ গতি হারায়। উষ্ণ আর্দ্র বায়ুর সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় ঋণাত্মক চার্জের সরবরাহও। বজ্রপাতের সময় তড়িৎ বিভবের পার্থক্য দশ মিলিয়ন ভোল্ট পর্যন্ত হতে পারে, আর তড়িৎ প্রবাহের মাত্রা ৩০ হাজার অ্যাম্পিয়ার পর্যন্ত হতে পারে। প্রবাহের এই মাত্রা বিভবের পার্থক্যের উপর নির্ভরশীল। এই সময় বাতাসের তাপমাত্রাও ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যায়। এই প্রচন্ড শক্তির স্থায়িত্ব সেকেন্ডের মাত্র দশ ভাগের এক ভাগ। শব্দ আর বিদ্যুৎ একইসাথে তৈরি হলেও গতির পার্থক্যের কারণে আমরা আগে আলো দেখতে পাই, পরে শুনি শব্দ।
কত দূরত্বে বজ্রপাত হয়েছে তা জানার কৌশল
বজ্রপাতের শব্দ ২৫ মাইল দূর থেকেও শোনা যায়। শব্দের কম্পাংক দূরত্বের সাথে পরিবর্তন হয়। উচ্চ কম্পাংক দ্রুত বায়ু দ্বারা শোষিত হয়ে যায়। বজ্রপাত সৃষ্টির কাছাকাছি স্থানে থাকলে শব্দের উচ্চ কম্পাংকের কারণে আপনি বেশ উচ্চ আওয়াজেই বজ্রধ্বনি শুনতে পাবেন। সময়ের সাথে এই আওয়াজ কমে আসে তার কম্পাংকের কারণে। যেহেতু আলো শব্দের চেয়ে দ্রুত বাতাসের মধ্য দিয়ে ছুটতে পারে, আপনি নিজেই বজ্রপাতের শব্দ থেকে এর উৎপত্তিস্থল সম্পর্কে জানতে পারবেন। বজ্রপাতের আলোর ঝলকানি আপনি বজ্রধ্বনির আগেই দেখতে পাবেন। এই আলোর ঝলকানি দেখার মুহূর্ত থেকে এক এক করে সেকেন্ড হিসাব করুন বজ্রপাতের আওয়াজ শোনা পর্যন্ত। শব্দ প্রতি সেকেন্ডে এক মাইলের পাঁচ ভাগের এক ভাগ বা সেকেন্ডে এক কিলোমিটারের এক-তৃতীয়াংশ ভ্রমণ করে, যদি দূরত্বটি মাইলে হিসাব করতে চান তবে যত সেকেন্ড হয়েছে সেই সংখ্যাকে ৫ দ্বারা ভাগ করুন কিংবা যদি কিলোমিটারে হিসাব করতে চান তবে ৩ দ্বারা ভাগ করলে আপনি দূরত্বের একটি ধারণা পেয়ে যাবেন।
বজ্রপাত এসি নাকি ডিসি সিগন্যাল?
এবার আসা যাক বিলিয়ন ডলার প্রশ্ন বজ্রপাত এসি নাকি ডিসি সিগন্যাল? মূলত বজ্রপাত হল দুমুখো সাপের মত। বজ্রপাতের মধ্যে এসি এবং ডিসি উভয় ধরনের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। যেমন: এর পোলারিটি আছে এবং সর্বদা একই পথে অগ্রগামী ফলে একে ডিসি ভোল্টেজের খেতাব টা দেওয়াই যায়। কিন্তু অন্যদিকে ডিসিতে constant voltage থাকার কথা থাকলেও এটি Constant না। এর Amplitude পরিবর্তিত হয়। তাই একে আর ডিসি বলা যাচ্ছে না। আবার এর পোলারিটি আছে এবং সর্বদা একই দিকে যায় অর্থাৎ অল্টারনেটিং হয় না। তাহলে তো এসিও হচ্ছে না। কি মহাবিপদ!! এই ঝামেলা এড়াতে একে এসি অথবা ডিসি কোন নামেই আখ্যায়িত করা যাবেনা। এখন নিশ্চয় সবার মনে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তাহলে এটা কোন ধরনের সিগন্যাল হবে? আসলে বজ্রপাত হল ইমপালস সিগন্যাল।
ইমপালস সিগন্যাল কি?
ইমপালস সিগন্যাল হল সেই সিগন্যাল যা অল্প সময়ে খুব বড় Amplitude নিয়ে প্রবাহিত হয়।
এসি-ডিসি নিয়ে মজাদার কিছু পোস্ট
এসি-ডিসি দুই ভাইয়ের সঞ্চয়ী মনোভাব এবং ফিল্টার সার্কিটের গল্প
এসি সিগন্যাল ফ্রিকুয়েন্সি সর্বদা 50/60 Hz কেন হয়?