মাদারবোর্ড কি এবং এটা নিয়ে আমাদের অনেক কৌতূহল থাকে। তাই আড্ডা জমাতে এসেছি মাদারবোর্ড নিয়ে। চলুন বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক।
মাদারবোর্ড কি?
ইলেকট্রিক্যাল বা ইলেকট্রনিক্সের জটিল ভাষা পরিহার করে বুঝানো যাক। একটি বহুতলবিশিষ্ট বিল্ডিং এর কথা চিন্তা করুন। একটি বিল্ডিং এ অনেক গুলো ফ্লোর থাকে। একেকটি ফ্লোরে একেক ধরনের কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। কোন কোন ফ্লোর আবাসিক আবার কোন কোন ফ্লোর বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত হয়। আবার দরকারি কাজে আবাসিক ভাড়াটিয়ারা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে যোগাযোগ করতে পারে। তেমনিভাবে মাদারবোর্ড একটি কম্পিউটারের জন্য বিল্ডিং এর মতই যেখানে রয়েছে বিভিন্ন হার্ডওয়্যার ইউনিট।
মাদারবোর্ড নাম শুনেই অনুধাবন করা যাচ্ছে তা কম্পিউটারের জন্য কতটা জরুরি। মা যেমন একটি পরিবারের মূল প্রাণ তেমনি মাদারবোর্ডও কম্পিউটারের প্রাণ। সর্বোপরি, মাদারবোর্ড হল কম্পিউটারের একটি প্রিন্টেড সার্কিট বেইজ যেখানে বিভিন্ন হার্ডওয়্যার মডিউল (পাওয়ার সাপ্লাই, সিপিইউ, প্রসেসর, র্যাম) সংযুক্ত থাকে।
মাদারবোর্ডকে কম্পিউটারের ব্যাকবোন বা মেরুদন্ড হিসেবে আখ্যা দেয়া হয় কেন?
মেরুদন্ড মানবদেহের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মেরুদন্ড ব্যতীত যেমন মানবদেহ অচল তেমনি মাদারবোর্ড ছাড়াও কম্পিউটার অচল। আপনি আপনার কম্পিউটার থেকে কোন ডাটা নেয়া জন্য সিপিইউ এর পোর্টে পেনড্রাইভ প্রবেশ করিয়ে থাকেন। মূলত এই পেনড্রাইভের সংযোগ হয় মাদারবোর্ডে সাথে। একইভাবে কম্পিউটারের বিভিন্ন এক্সটার্নাল ডিভাস যেমন মাউস, কি-বোর্ডের সংযোগ ঘটে মাদারবোর্ডের পোর্টের সাথে। তাই মাদারবোর্ডকে কম্পিউটারের মেরুদন্ড হিসেবেও আখ্যা দেয়া হয়। তাছাড়াও মাদারবোর্ডে অনেক ফ্লেক্সিবক স্লট থাকে যেখানে আপনি এক্সটার্নাল যেকোন মডিউল সেট আপ করতে পারবেন।
মাদারবোর্ড কত প্রকার ও কি কি?
মাদারবোর্ড প্রধানত দুই প্রকার। যথাঃ
- Integrated Motherboard
- Non-Integrated Motherboard
Integrated Motherboard
যে মাদারবোর্ডে আপনি নতুনভাবে কোন সিস্টেম আপডেট করতে পারবেন তাকে Integrated Motherboard। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক কি রকম? যেমন ধরুন, পিসি, ল্যাপটপের মাদারবোর্ডে আপনি চাইলেই SSD, গেম কার্ড, গ্রাফিক্স কার্ড এড করতে পারবেন। এজন্য কম্পিউটার, ল্যাপটপের মাদারবোর্ডকে ইন্টিগ্রেডেড মাদারবোর্ড বলে।
Non-Integrated Motherboard
ইন্টিগ্রেডেড মাদারবোর্ডকে একটু উল্টো করে ভাবুন। এমন কোন ডিভাইস আছে যার মাদারবোর্ডে আপনি এক্সট্রা কোন হার্ডওয়্যার বা স্লট ইন্টিগ্রেড করতে পারবেন না? উত্তরে নিশ্চয়ই বলবেন মোবাইল, ট্যাব। হ্যা, মোবাইলে আমরা চাইলেই গ্রাফিক্স কার্ড, গেম কার্ড, এস এস ডি এড করতে পারিনা। তাই মোবাইলের মাদারবোর্ডকে বলা হয় নন-ইন্টিগ্রেডেড মাদারবোর্ড।
মাদারবোর্ডের বিভিন্ন অংশের পরিচিতি
মাদারবোর্ড নিম্নলিখিত অংশ নিয়ে গঠিতঃ
- RAM চিপ
- ROM চিপ
- CPU চিপ
- PCI স্লট
- গ্রাফিক্স পোর্ট
- ভিডিএ কানেক্টিং পোর্ট
- ইন্টারনেট ল্যান পোর্ট
- সিরিয়াল পোর্ট
- প্যারালাল পোর্ট
- পাওয়ার সাপ্লাই কানেক্টর
- নর্থব্রীজ এবং সাউথব্রীজ
- PS2 পোর্ট
- FDC পোর্ট
- IDE পোর্ট
- CMOS ব্যাটারি
RAM চিপ
র্যাম এক ধরনের মেমোরি ডিভাইস। RAM এর পূর্ণরুপ হল Random Access Memory। আপনার ল্যাপটপে ডাউনলোড করা সফটওয়্যার, বিভিন্ন তথ্য এবং মেশিন কোডগুলো র্যামের মধ্যে অস্থায়ীভাবে সংরক্ষিত থাকে। কাজেই একে Temporary Memory Element ও বলা হয়। র্যামের সাইজ বা স্পেস যত বেশি হবে তখন তার বহুবিধ কাজ করার প্রবণতাও বেড়ে যাবে।
ROM চিপ
যারা যারা র্যামের কাজ বুঝেছেন তাদের কাছেও রোম বুঝাটাও অনেক সহজ হবে। রোম ও র্যামের মতই মেমোরি ডিভাইস কিন্তু র্যামের উলটা কাজটাই করে রোম। র্যাম যেকোন ডাটাকে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করে আর পক্ষান্তরে রোম ডাটাকে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করে।
সি পি ইউ চিপ
সি পি ইউ এর পূর্ণরুপ হল সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট। মানুষের মস্তিষ্ক যেমন সকল প্রকার কার্যাবলির নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে তেমনি কম্পিউটারের সকল ফাংশনের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র হল সেন্টাল প্রসেসিং ইউনিট। মাদারবোর্ডের সি পি ইউ চিপ থাকে যা কম্পিউটারের বিভিন্ন প্রকার সফটওয়্যার, ফাংশন কার্যকর করতে সাহায্য করে।
PCI স্লট
PCI এর পূর্ণরুপ হচ্ছে Peripheral Components Interconnect। মাদারবোর্ডের এই স্লটে বাইরের কোন ডিভাইসকে ইন্টারকানেক্ট করা যায়। বিভিন্ন কন্ট্রোলার, ওয়াইফাই এডাপ্টার, স্যাটেলাইট রিসিভার, টিভি টার্নার মাদারবোর্ডের পিসিআই স্লটে সংযুক্ত করা যায়।
গ্রাফিক্স পোর্ট
পি এস আই স্লটের পূর্বে কম্পিউটারগুলোর মাদারবোর্ডে আলাদাভাবে গ্রাফিক্স পোর্ট ব্যবহার করা হত যেখানে ভিডিও কার্ড সংযোগ করে 3-D গ্রাফিক্স বা এনিমেশন দেখা যেত। বর্তমানে ভিডিও কার্ড বা সিডি ড্রাইভ এখন পি সি আই পোর্টেই সংযুক্ত করা যায়।
সিরিয়াল পোর্ট
মাদারবোর্ডে দুটি সিরিয়াল পোর্ট দেখা যায় যা ৯-১০ পিনবিশিষ্ট। আপনি নিজের অজান্তেই মাউস, ইন্টারনেট মডেম বা মাউস ল্যাপটপের যে পোর্টে সংযোগ দিচ্ছেন তার নামই হল সিরিয়াল পোর্ট।
প্যারালাল পোর্ট
ল্যাপটপে বসে কোন একটি ডকুমেন্ট তৈরি করলেন। এখন প্রিন্ট দিবেন। প্রিন্ট দিতে দরকার প্রিন্টার। ইউ এস বি ক্যাবল দিয়ে ল্যাপটপের যে পোর্টের সাথে প্রিন্টারের সংযোগ দিবেন তার নামই প্যারালাল পোর্ট। এই পোর্ট সাধারণত ২৬ পিনবিশিষ্ট হতে পারে। প্রিন্টার, স্ক্যানার মাদারবোর্ডের প্যারালাল পোর্টে সংযোগ দেয়া হয়।
PS2 পোর্ট
ডেস্কটপ বা ল্যাপটপে মাউস সংযুক্ত করার জন্য যে পোর্ট লাগানো থাকে সেটিই হল PS2 পোর্ট। তবে বর্তমানে প্রযুক্তি অনেক উন্নত। এখন পি এস টু পোর্টের পরিবর্তে ইউ এস বি পোর্ট ব্যবহার করা হয়। যা পি এস টু পোর্টের তুলনায় অনেকাংশে কার্যকরী।
Internet LAN পোর্ট
কম্পিউটারে হাই ব্যান্ডউইথ এর ইন্টারনেট ব্যবহার করার জন্য এক ধরনের পোর্ট থাকে। যার নাম ইন্টারনেট ল্যান পোর্ট। এই ল্যান পোর্টটি দেখতে চতুর্ভুজাকৃতির। রাউটারের RJ45 কানেক্টর এই ল্যান পোর্টে সংযোগ করা যায়।
ভিডিএ কানেক্টিং পোর্ট
মাদারবোর্ডের ডিসপ্লে কানেক্ট করার জন্য ভিডিএ কানেক্টিং পোর্ট ব্যবহার করা হয়। ভিডিএ পোর্টের একটি সুবিধা হল ভিডিএ পোর্ট সংখ্যা বৃদ্ধি করা যায়। পি সি আই স্লট ব্যবহার করে ভিডিএ কানেক্টিং পোর্ট সংখ্যা বৃদ্ধি করা সম্ভব।
সাউথব্রীজ / নর্থব্রীজ
এগুলো মূলত মাদারবোর্ডের মূল লজিক চিপসেটের দুটি চিপ। সাধারণত, সাউথব্রিজ একটি কম্পিউটার আর্কিটেকচারে মাদারবোর্ডের ধীর হওয়ার প্রবণতা তৈরি করতে সক্ষম।
নর্থব্রীজ, যা হোস্ট ব্রিজ বা মেমোরি কন্ট্রোলার হাব নামেও পরিচিত। এটি ফ্রন্ট-সাইড বাস (এফ এস বি) এর মাধ্যমে সরাসরি সিপিইউতে সংযুক্ত থাকে। কম্পিউটারের যে কাজগুলোর জন্য সর্বোচ্চ ক্যাপাসিটি প্রয়োজন সেসমস্ত কাজে এই চিপ সাহায্য করে।
FDC / ফ্লফি ডিস্ক কন্ট্রোলার
FDC একটি স্পেশাল ডিস্ক কন্ট্রোলার সার্কিট। এটি একটি কম্পিউটারের ফ্লপি ডিস্ক ড্রাইভ (এফ ডি ডি) থেকে যেকোন তথ্য রিডিং এর কাজ নিয়ন্ত্রণ করে এবং রাইটিং এর নির্দেশ দেয়।
IDE কন্ট্রোলার
আ ডি ই কন্ট্রোলার হল এক প্রকার হোস্ট এডাপ্টার যা ইথারনেট, ফায়ারওয়্যার, ইউএসবি এবং অন্যান্য সিস্টেমগুলোকে সংযুক্ত করার জন্য ব্যবহৃত হয়। একটি হোস্ট অ্যাডাপ্টার, যা হোস্ট কন্ট্রোলার বা হোস্ট বাস অ্যাডাপ্টার (এইচ বি এ) নামেও পরিচিত। এটি একটি কম্পিউটারকে লোকাল নেটওয়ার্ক এবং স্টোরেজ ডিভাইসগুলোর সাথে সংযুক্ত করে।
CMOS ব্যাটারি
CMOS ব্যাটারি, যা মেমোরি ব্যাটারি, ক্লক ব্যাটারি বা রিয়েল-টাইম ক্লক (আর টি সি) নামেও পরিচিত। সাধারণত লিথিয়াম কয়েন সেল দিয়ে এটি নির্মিত। CMOS ব্যাটারির আয়ু সর্বোচ্চ তিন বছর পর্যন্ত হতে পারে।
পাওয়ার সাপ্লাই কানেক্টর
মাদারবোর্ডে পাওয়ার সাপ্লাই কানেক্টরের সাহায্যে সম্পূর্ণ সার্কিটে পাওয়ার পৌঁছে যায়। একটি পাওয়ার সাপ্লাই কম্পিউটারকে কাজ করতে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় বৈদ্যুতিক শক্তি সরবরাহ করে। এটি 12 ভোল্ট, 5 ভোল্ট, 3.3 ভোল্ট ইত্যাদির ডিসি পর্যন্ত হতে পারে।
হিট সিঙ্ক
প্রত্যেক ডিভাইসেরই একটি সহনীয় তাপমাত্রা থাকে। ডিভাইটি অনবরত ব্যবহারের ফলে তাপমাত্রা সহজেই বৃদ্ধি পেতে পারে। হিট সিঙ্ক এই অতিরিক্ত তাপমাত্রা অপসারণ করতে সাহায্য করে। মাদারবোর্ডে হিট সিঙ্ক সাধারণত CPU, GPU (গ্রাফিক্স প্রসেসিং ইউনিট), চিপসেট এবং RAM মডিউলগুলি শীতল করতে ব্যবহৃত হয়।
আরো কিছু আর্টিকেল পড়ুন