পারমাণবিক শক্তি সম্বন্ধে আলোচনা করতে গেলে প্রথমে যে বিষয়টি সামনে আসে তা হলো শৃঙ্খল বিক্রিয়া বা চেইন বিক্রিয়া (Chain Reaction)। এই চেইন বিক্রিয়ার মাধ্যমেই ক্ষুদ্র উৎস থেকে বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন করা সম্ভব। আর এই চেইন বিক্রিয়াটি ঘটে থাকে নিউক্লিয়ার ফিশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। তাই চেইন বিক্রিয়া সম্বন্ধে জানার পুর্বে নিউক্লিয়ার ফিশন সম্বন্ধে ধারণা থাকা উচিত।
নিউক্লিয়ার ফিশন হচ্ছে এক প্রকার নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া। যেনে রাখা ভালো, যে বিক্রিয়ায় পরমাণুর নিউক্লিয়াসের পরিবর্তন ঘটে তাকে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া বলে। আর এই নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া প্রধাণত দুই প্রকার। ১. নিউক্লিয়ার ফিশন (Nuclear Fission) এবং ২. নিউক্লিয়ার ফিউশন (Nuclear Fusion)। এই লেখাতে আমরা প্রথমে নিউক্লিয়ার ফিশন ও চেইন বিক্রিয়া সম্বন্ধে আলোচনা করবো। পরিশেষে নিউক্লিয়ার ফিউশন সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে আলোকপাত করবো। সুতরাং,এই লেখা হতে আমরা যেসব বিষয়ে জানতে পারবো তা হলোঃ
- নিউক্লিয়ার ফিশন (Nuclear Fission)
- চেইন বিক্রিয়া (Chain Reaction)
- নিউক্লিয়ার ফিউশন (Nuclear Fusion)
নিউক্লিয়ার ফিশন (Nuclear Fission):
সংজ্ঞা: যে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় একটি ভারী পরমাণুর নিউক্লিয়াস ভেঙ্গে প্রায় সমান ভরের দুই বা তার অধিক সংখ্যক নিউক্লিয়াসে বিভক্ত বা বিভাজিত হয় এবং প্রচুর পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন করে তাকে নিউক্লিয়ার ফিশন (Nuclear Fission) বা নিউক্লিয়ার বিভাজন বলে।
নিচের বিক্রিয়াটি লক্ষ্য করিঃ
U235 + 0n1 → [ U236 ]* → Ba141 + Kr36 + 3 0n1 + শক্তি
এখানে, ইউরেনিয়াম-২৩৫ (U-235) কে নিউট্রন দ্বারা আঘাত করা হলে এটি প্রথমে অস্থায়ী অস্থিতিশীল নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়। এই অস্থায়ী নিউক্লিয়াস ফিশন প্রক্রিয়ায় বিভাজিত হয়ে বেরিয়াম ও ক্রিপটন নিউক্লিয়াস গঠন করে। এই বিক্রিয়ায় ১ থেকে ৩ টি পর্যন্ত উচ্চ গতিসম্পন্ন নিউট্রন উৎপন্ন হয়ে থাকে। এই নিউট্রনগুলাের আঘাতে আরও ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসে ফিশন ঘটতে থাকে। মূলত এভাবেই ধারাবাহিকভাবে ফিশন প্রক্রিয়াটি চলতে থাকে।
লক্ষ্যনীয় যে, ইউরেনিয়াম-২৩৫ (U-235) নিউক্লিয়াসকে নিউট্রন দ্বারা আঘাত করলে শুধু উপরের বিক্রিয়ার মতোই বিক্রিয়া সংঘটিত হয় না, অনেক ধরনের বিক্রিয়া ঘটতে পারে। যেমনঃ
U235 + 0n1 → [ U235 ]* → Xe140 + Sr36 + 2 0n1 + শক্তি
এই বিক্রিয়ায়, ১ থেকে ২ টি পর্যন্ত নিউট্রন উৎপন্ন হয়। তবে কোনাে কোনাে বিক্রিয়ায় ৫টি পর্যন্তও নিউট্রন উৎপন্ন হতে পারে। সাধারণত প্রতি ফিশনে গড়ে প্রায় ২.৪৭ সংখ্যক নিউট্রন উৎপন্ন হতে পারে এবং ইউরেনিয়ামের ফিশান প্রক্রিয়ায় প্রায় ৯০ ধরনের ভিন্ন ভিন্ন নিউক্লিয়াসের উৎপত্তি হতে পারে।
মনে রাখা ভালো, ভারী নিউক্লিয়াসকে প্রোটন, ডিউটেরন, আলফা কণা এবং গামা রশ্মি দ্বারা আঘাত করেও নিউক্লিয়ার ফিশন বিক্রিয়া ঘটানো সম্ভব।
আসুন এবার আমরা এই বিক্রিয়াটিকে চিত্রের সাহায্যে বুঝার চেষ্টা করিঃ
উপরের চিত্রটি লক্ষ্য করি, এখানে একটি ভারী নিউক্লিয়াসকে একটি নিউট্রন দ্বারা আঘাত করা হয়েছে যার ফলে ভারী নিউক্লিয়াসটি বিভাজিত হয়ে দুইটি ছোট ছোট নিউক্লিয়াস উৎপন্ন হয়েছে। এখানে এই বিক্রিয়াটিকে বলা হয় নিউক্লিয়ার ফিশন বিক্রিয়া এবং ঘটনাটিকে বলা হয় ফিশন।
তবে এই বিক্রিয়ায় দুইটি নিউক্লিয়াস উৎপন্নের পাশাপাশি নিউট্রন ও বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয়। যেমনঃ
এখানে যে নিউট্রন উৎপন্ন হয়েছে তা আবার অন্য একটি নিউক্লিয়াসকে আঘাত করে সেই নিউক্লিয়াস তখন আবার বিভাজিত হয়ে দুইটি ছোট নিউক্লিয়াস ও নিউট্রন উৎপন্ন করে, সেই সাথে কিছু শক্তি উৎপন্ন করতে থাকে। নিচের চিত্রের মতো বিক্রিয়াটি চেইন আকারে চলতে থাকে।
চেইন বিক্রিয়া কিভাবে শুরু হয় তা আমরা হয়তো বুঝতে পেরেছি। এবার আমরা চেইন বিক্রিয়া কি এবং নিউক্লিয়্যার রিয়্যাক্টরে কিভাবে ঘটে থাকে সেই সম্বন্ধে বিস্তারিত জানবোঃ
চেইন বিক্রিয়া (Chain Reaction):
যে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া একবার শুরু হলে তাকে চালিয়ে রাখার জন্য অন্য কোন অতিরিক্ত কোনো শক্তির প্রয়োজন হয় না তাকে শৃঙ্খল বিক্রিয়া বা চেইন বিক্রিয়া (Chain Reaction) বলে।
নিচে একটি চেইন বিক্রিয়ার দেখানো হলোঃ
ব্যাখ্যা: ইউরেনিয়াম-২৩৫ (U-235) পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে উচ্চ গতিসম্পন্ন নিউট্রন দ্বারা আঘাত করলে ফিশনের ফলে দুইটি নিউক্লিয়াস উৎপন্ন হবে এবং সাথে সাথে তিনটি নিউট্রনও সৃষ্টি হবে। এই তিনটি নিউট্রন আরও তিনটি ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসে ফিশন ঘটাবে; ফলে পাওয়া যাবে নয়টি নিউট্রন। এই নয়টি নিউট্রন আরও নয়টি নিউক্লিয়াসে ফিশন ঘটিয়ে সৃষ্টি করবে সাতাশটি নিউট্রন। ইউরেনিয়াম শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া এভাবে চলতে থাকবে। মূলত এই প্রক্রিয়াটিই হচ্ছে শৃঙ্খল বিক্রিয়া বা চেইন বিক্রিয়া (Chain Reaction)।
বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের ভর শক্তি নীতি, E = mc2 অনুযায়ী চেইন বিক্রিয়ায় পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ভর থেকে শক্তির রুপান্তর ঘটে।
এখানে, E= উৎপন্ন শক্তি
m = শক্তি উৎপন্নকারী পদার্থের ভর এবং
c = শূন্য মাধ্যমে আলোর গতিবেগ।
অর্থাৎ, বস্তু যখন শক্তিতে রুপান্তরিত হয় শক্তির পরিমাণ হয়ে দাড়ায় ভরের সঙ্গে আলোর গতিবেগের বর্গের গুনফলের সমান।
পৃথিবীর বড় বড় বিজ্ঞানীদের মতে, একটি বিভাজিত ইউরেনিয়াম -২৩৫ নিউক্লিয়াস প্রায় ২০০ মিলিয়ন ইলেক্ট্রন ভোল্ট (MeV) শক্তি উৎপন্ন করে।
রিয়্যাক্টরের মধ্যে যখন ইউরেনিয়াম-২৩৫ নিউক্লিয়াসকে (U-235) নিউট্রন দ্বারা আঘাত করা হয়, ইউরেনিয়াম -২৩৫ ভেঙ্গে কিছু অগ্নিস্ফুলিঙ্গ (fragment) ও প্রটোনিয়াম-২৩৯ (Pu-239) উৎপন্ন হয়, কিছু ছাড়া পায় (escaped) এবং অবশিষ্টগুলোর বেশির ভাগ ইউরেনিয়াম-২৩৮ এবং সামান্য কিছু আবার ইউরেনিয়াম-২৩৫ আইসােটোপে পরিণত হয়। এই সময় নিউট্রনের গতিবেগ অতিরিক্ত বেড়ে যেতে চায়, তখন মডারেটরের সাহায্যে এর গতিবেগ কমালে এই নিউট্রন আবার ইউরেনিয়াম-২৩৫ কে আঘাত করে খণ্ড-বিখণ্ড করে দেয়। এতে আবার প্রটোনিয়াম-২৩৯, ইউরেনিয়াম-২৩৫, ইউরেনিয়াম-২৩৮ উৎপন্ন হয়, কিছু ছাড়া পায় এবং কিছু অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে ছাই আকারে রিয়্যাক্টরে জমা হয়।
নিউট্রনের গতিবেগ মডারেটরের সাহায্যে কমালে আবার ইউরেনিয়াম-২৩৫ খণ্ড-বিখণ্ড হয় এবং এভাবেই পারমাণবিক জ্বালানির পরমাণুর মধ্যে চেইন বিক্রিয়া ঘটে পারমাণবিক শক্তি উৎপন্ন করতে থাকে।
আধুনিক নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টরে অতি উর্বরা (enriched) ইউরেনিয়াম জ্বালানি ব্যবহার করা হয় বলে রিয়্যাক্টরে কোনাে মডারেটর ব্যবহার করার দরকার হয় না। কারণ, অতি উর্বরা জ্বালানি বিভাজিত করতে নিউট্রনকে ধীরগতি করাতে হয় না, দ্রুত বা উচ্চ গতিসম্পন্ন নিউট্রন দ্বারাই একে বিভাজিত করা যায়। জ্বালানিকে উর্বরা করতে এবং চেইন বিক্রিয়া ঘটানোর সুবিধার্থে কিছু পরিমাণ ইউরেনিয়াম -২৩৮ এবং থােরিয়াম-২৩২ ব্যবহার করা হয়।
চেইন বিক্রিয়ায় যে আইসােটোপগুলো ভারী থাকে ও বিভাজিত হয় না, সেগুলো রিয়্যাক্টরে চূর্ণ হয়ে জমা হতে থাকে এবং বিক্রিয়ায় কোনাে রকম বাধা সৃষ্টি করে না। যতক্ষণ পর্যন্ত জ্বালানি দণ্ড (fuel rod) থেকে ইউরেনিয়াম-২৩৫ নির্গত হতে থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত মুক্ত নিউট্রন এবং ইউরেনিয়াম-২৩৫ এর মধ্যে ফিশন চলতে থাকে। তবে কন্ট্রোল রড দ্বারা এই চেইন বিক্রিয়া চালু অথবা বন্ধ রাখা যায়।
উল্লেখ্য যে, এই চেইন বিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে তা হবে নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টরে সংঘটিত নিয়ন্ত্রিত ফিশান বিক্রিয়া আর কোন কারণে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে তা পারমাণবিক বােমার বিস্ফোরণে রূপ নিবে। মাত্র একটি নিউট্রন দ্বারা শুরু করা এই অনিয়ন্ত্রিত চেইন বিক্রিয়া নজিরবিহীন বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। আর এই বিক্রিয়াকে যথােপযুক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে তা থেকে পাওয়া যাবে অপরিসীম শক্তি।
নিউক্লিয়ার ফিউশন (Nuclear Fusion):
যে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় দুইটি হালকা নিউক্লিয়াস একত্রিত হয়ে অপেক্ষাকৃত ভারী একটি নিউক্লিয়াস গঠন করে এবং শক্তি নির্গত করে থাকে তাকে নিউক্লিয়ার ফিউশন (Nuclear Fusion) বলা হয়।
ফিউশন বিক্রিয়া মূলত ফিশন বিক্রিয়ার ঠিক উল্টো প্রক্রিয়া। ফিউশন বিক্রিয়া অত্যধিক উচ্চ তাপমাত্রায় সংঘটিত হয় বলে এ বিক্রিয়াকে তাপ – নিউক্লিয়ার বিক্রিয়াও (Thermal – nuclear Reaction) বলা হয়।
পারমাণবিক শক্তি থেকে ফিশন ও ফিউশন এই দুই উপায়েই বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করা যায়। তবে ফিউশন প্রক্রিয়ায় নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব জ্বালানি দিয়ে সারা বছর বিদ্যুৎ শক্তির যোগান দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করা স্বপ্নের মতো ব্যাপার।
ফিউশন বিক্রিয়া প্রধানত সূর্যসহ অন্যান্য নক্ষত্রে ঘটে থাকে। এছাড়া ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তি উৎপাদনের জন্য বিক্রিয়া শুরু হতে যে উচ্চ তাপমাত্রার প্রয়োজন হয় (প্রায় ১ কোটি কেলভিন) তা নক্ষত্রের কেন্দ্র ব্যতিত অন্য কোথাও তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। তাই শুধু ফিশন বিক্রিয়া ও চেইন বিক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টরে শক্তি উৎপাদন করা হয়।
পাওয়ার প্ল্যান্ট সম্বন্ধে আরও জানতে নিচের লেখাগুলো পড়ুনঃ
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কার্যপদ্ধতি।
পারমাণবিক চুল্লি বা নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে বিবেচ্য বিষয়।
তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য উপযুক্ত এলাকা নিরবাচনে বিবেচ্য বিষয়সমুহ।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সুবিধা ও অসুবিধা।
ইউরেনিয়াম সম্বন্ধে আলোচনা।
বর্তমান বিশ্ব ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
বাষ্প বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্বন্ধে আলোচনা।
পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইতিহাস ও সংক্ষিপ্ত আলোচনা।
পাওয়ার প্ল্যান্টঃ সংজ্ঞা, প্রকারভেদ ও কার্যপদ্ধতি।