নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর (Nuclear Reactor) বা পারমাণবিক চুল্লি মূলত এক প্রকার তাপীয় যন্ত্র। এর মাধ্যমে পারমাণবিক জ্বালানি চেইন বিক্রিয়া করে বিপুল পরিমাণ তাপ শক্তি উৎপন্ন করতে পারে। প্রথম দিকে এই রিয়্যাক্টর Automic Pile হিসেবে পরিচিত ছিলো। IAEA এর রিপোর্ট অনুযায়ী সারা বিশ্বে বর্তমানে প্রায় ৪৫৪ টি Nuclear Power Reactor এবং ২২৬ টি Nuclear Research Reactor রয়েছে। পারমাণবিক চুল্লি বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন, চিকিৎসা বিজ্ঞান, পারমাণবিক অস্ত্র তৈরীসহ অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।
নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টরের গঠন ও কার্যপদ্ধতিঃ
একটি নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর নিম্নোক্ত অংশগুলোর সমন্বয়ে গঠিতঃ
১. কোর (core)
২. মডারেটর (moderator)
৩. রিফ্লেক্টর (reflector)
৪. নিয়ন্ত্রন দণ্ড (control rod)
৫. শীতলক (coolant) এবং
৬. রেডিয়েশন শিল্ড (radiation shield)
এসব অংশগুলোর গঠন ও কার্যপদ্ধতি সম্বন্ধে জানলেই আমরা একটি নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টরের গঠন ও কার্যপদ্ধতি সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারব। তাহলে চলুন আমরা উপরোক্ত অংশগুলো সম্বন্ধে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করি। বোঝার সুবির্ধাথে আমরা নিচের চিত্রটি ব্যবহার করবঃ
১. মডারেটর (Moderator):
আমরা জানি, চেইন বিক্রিয়া ঘটাতে হলে আঘাত করে পরমাণুর ভাঙ্গন (fission) ঘটাতে হবে। কিন্তু ইউরেনিয়াম – ২৩৫ কে উচ্চ গতিসম্পন্ন অবস্থায় সহজে আঘাত করা যায় না, তাই একে আঘাত করার জন্য এর গতিবেগ কমিয়ে নিতে হয়। আর এই কাজটি যে করে থাকে সে হলো মডারেটর। মূলত মডারেটর রিয়্যাক্টরের এমন একটি উপাদান যার সাহায্যে এই উচ্চ গতিসম্পন্ন ইউরেনিয়ামের নিউট্রনগুলোকে ধীর গতি সম্পন্ন নিউট্রনে পরিণত করা হয়। যে পদ্ধতিতে এই কাজটি করা হয় তাকে মডারেশন (moderation) বা থার্মালাইজিং (thermalizing) বলা হয়।
সাধারণত একটি দ্রুতগামী নিউট্রনের গতিশক্তি ২ মিলিয়ন ইলেকট্রন ভােল্ট (2 mev) এবং এর গতিবেগ থাকে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১৪,০৯৪ কিলােমিটার। সেখানে মডারেটরের সাহায্যে এই গতিশক্তি কমিয়ে ১ ইলেকট্রন ভােল্ট এবং গতিবেগকে কমিয়ে প্রতি সেকেন্ডে ২ মাইল (৩.২২ কি.মি) পর্যন্ত আনা হয়।
হাইড্রোজেন পরমাণু খুবই হালকা হওয়ায় মডারেটর হিসেবে রিয়্যাক্টরে হাইড্রোজেন পরমাণুকেই বেশি ব্যবহার করা হয়। এছাড়া মডারেটর হিসেবে পরিষ্কার গ্রাফাইট, সাধারণ হালকা পানি, ভারী পানি ইত্যাদিও ব্যবহার করা হয়। এখানে, পানির সাথে অক্সিজেনের পরিমাণ কম বেশি ব্যবহার করে হালকা অথবা ভারী পানি তৈরি করা হয়। মডারেটরের এসব উপাদানগুলোকে মূলত রিয়্যাক্টর কোরের সঙ্গে অথবা জ্বালানির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়।
আধুনিক নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টরে অতি উর্বরা (enriched) ইউরেনিয়াম জ্বালানি ব্যবহার করা হয় বলে রিয়্যাক্টরে কোনাে মডারেটর ব্যবহার করার দরকার হয় না। কারণ, অতি উর্বরা জ্বালানি বিভাজিত করতে নিউট্রনকে ধীরগতি করাতে হয় না, দ্রুত বা উচ্চ গতিসম্পন্ন নিউট্রন দ্বারাই একে বিভাজিত করা যায়। জ্বালানিকে উর্বরা করতে এবং চেইন বিক্রিয়া ঘটানোর সুবিধার্থে কিছু পরিমাণ ইউরেনিয়াম -২৩৮ এবং থােরিয়াম-২৩২ ব্যবহার করা হয়।
২. কোর (Core):
কোর (core) হচ্ছে একটি নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টরের প্রধান অংশ। এটি মূলত জ্বালানি দন্ডে (fuel rod) অবিভাজিত (non fission) জ্বালানিগুলোকে চাপ দিয়ে মিশিয়ে দেয় এবং ভালোভাবে বিক্রিয়া ঘটিয়ে প্রচুর তাপ শক্তি উৎপন্ন করতে সাহায্য করে। জ্বালানির বিক্রিয়ায় সময় কোরের মধ্যে প্রায় ৫৯৩° সে. তাপ উৎপন্ন হয়ে থাকে।
৩. রিফ্লেক্টর (Reflector):
রিফ্লেক্টর রিয়্যাক্টর কোরের চারপাশে এবং থার্মাল শিল্ডের (thermal shield) ভিতরের দিকে অবস্থিত থাকে (চিত্র-১ দেখুন)। রিয়্যাক্টরের কোর (core) থেকে জ্বালানির কিছু নিউট্রন মুক্ত হবার সম্ভাবনা থাকে, এসবকে বাঁধা দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়াই হচ্ছে রিফ্লেক্টরের প্রধান কাজ। পরমাণুর নিউট্রন রিফ্লেক্টরের পরমাণুর সঙ্গে ধাক্কা খায় এবং তাপ বিনিময় করে কিছুটা ঠাণ্ডা হয়।
অর্থাৎ, রিফ্লেক্টরের কাজ হলাে কোর (core) থেকে নিউট্রন লিকেজ (leakage) না হতে দেওয়া এবং ইউরেনিয়াম পরমাণুর সাথে সঠিক বিভাজন নীতি বজায় রাখা। মুলত এর ফলেই জ্বালানির পরমাণুর কোনাে অপচয় হয় না এবং জ্বালানি হতে সঠিক মাত্রার তাপ শক্তি পাওয়া যায়।
৪. নিয়ন্ত্রণ দণ্ড (Control rod):
রিয়্যাক্টরের কন্ট্রোল রড বা নিয়ন্ত্রণ দণ্ড সাধারণত বােরন (Boron) ধাতুর তৈরি হয়। এটি গােলাকার এবং পাতাকৃতির হয়ে থাকে। এর প্রধান কাজ হলাে পারমাণবিক জ্বালানি বিভাজিত হবার সময় অতিরিক্ত নিউট্রনগুলোকে শােষণ করে নেওয়া। এই কন্ট্রোল রড রিয়্যাক্টর কোরের ছিদ্রের মধ্য দিয়ে উঠা নামা করে বিভাজন প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
কন্ট্রোল রডের প্রকারভেদঃ
ব্যবহারের নিয়ম অনুযায়ী কন্ট্রোল রড দুই ভাগে বিভক্ত, যথা:
(ক) নিরাপত্তামূলক কন্ট্রোল রড (safety control rod) এবং
(খ) পাতাকৃতি কন্ট্রোল রড (sheets control rod)।
যখন নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টরের কাজ বন্ধ থাকে তখন নিরাপত্তামূলক কন্ট্রোল রড (safety control rod) খুলে বাইরে রাখা হয়। আবার যখন পারমাণবিক জ্বালানির চেইন বিক্রিয়া শুরু করতে হয় তখন এই কন্ট্রোল রড রিয়্যাক্টরে প্রবেশ করাতে থাকলে পারমাণবিক জ্বালানির চেইন বিক্রিয়া শুরু হতে থাকে।।
অন্যদিকে পাতাকৃতি কন্ট্রোল রড সবসময় রিয়্যাক্টরের মধ্যেই প্রবেশ করানো থাকে যখন এই রড উপর থেকে নিচের দিকে নামানাে হয় অথবা নিচের দিক হতে উপরের দিকে উঠানাে হয়, তখন রিয়্যাক্টরে বিক্রিয়ার কাজ চলতে থাকে।
তবে যদি কোনাে সময় দুর্ঘটনাবশত রিয়্যাক্টরের মধ্যে পাতাকৃতি কন্ট্রোল রড আটকে যেয়ে প্রবল তরঙ্গ উৎপন্ন করতে থাকে তখন রিয়্যাক্টরের স্ক্রামিং (scramming) পদ্ধতিতে বিভাজন প্রক্রিয়াকে স্থগিত করে দেওয়া হয়। রিয়্যাক্টরের স্ক্রামিং (scramming) পদ্ধতি বলতে স্বয়ংক্রিয় বন্ধকরণ পদ্ধতি ব্যবহার করে অথবা তাড়াতাড়ি ধাক্কা দেওয়ার মাধ্যমে কন্ট্রোল রডকে সরিয়ে বিভাজন প্রক্রিয়া স্থগিত করে রাখাকে বুঝায়।
৫. শীতলক (Coolant):
শীতলক বা কুল্যান্ট এর কাজ হলাে রিয়্যাক্টরের প্রকোষ্ঠকে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ঠাণ্ডা করে রাখা এবং অনেক বেশি তাপের সংস্পর্শে তাপ বিনিময়কারীর (heat exchanger) মাধ্যমে তাপ বহন করে আনা এবং এর পরােক্ষ সংস্পর্শে থেকে পানিকে বাষ্পে পরিণত করা। আমরা জানি যে, রিয়্যাক্টরের ভিতরে চেইন বিক্রিয়া ঘটানোর ফলে উৎপন্ন পরমাণুগুলো এবং নিউট্রনের সঙ্গে পারিপার্শিক পদার্থেরও সংঘর্ষ হয় তখন এসব পদার্থের যান্ত্রিক শক্তি তাপ শক্তিতে পরিণত হয়ে যায়। আর এই উৎপাদিত তাপকে দূর করতেই রিয়্যাক্টরের ভিতরে কুল্যান্ট ব্যবহার করা হয়। কুল্যান্টকে পাম্পের সাহায্যে চালানো হয়।
Heat Exchanger -এর মধ্যে যে পানি থাকে কুল্যান্ট তার মধ্যকার পাইপের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হবার সময় সেখানে তাপ বিনিময় (heat exchange) করে। এতে কুল্যান্টের তাপ কিছুটা কমে যায় এবং তা পাম্পের মাধ্যমে আবার রিয়্যাক্টরে প্রবেশ করে। অপরদিকে Heat Exchanger -এর পানি কুল্যান্টের তাপে বাষ্পে পরিণত হয়ে স্টিম টারবাইনকে ঘূর্ণনগতি প্রদান করে। এই টারবাইন শ্যাফটের সঙ্গে যুক্ত জেনারেটর তখন বিদ্যুৎ শক্তি উৎপন্ন করতে থাকে। শীতলক বা কুল্যান্ট হিসেবে বিভিন্ন ধরনের গ্যাস এবং তরল ধাতুর সঙ্গে হালকা পানি অথবা ভারী পানি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এখানে, বিভিন্ন গ্যাস বলতে বাতাস, হিলিয়াম, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, এবং তরল ধাতু বলতে সােডিয়াম, লিথিয়াম প্রভৃতিকে বুঝায়।
রিয়্যাক্টরের কুল্যান্ট বা শীতলকের কিছু বিশেষ গুণ থাকা জরুরি। যেমনঃ
- উচ্চ আপেক্ষিক তাপ (high specific heat),
- অধিক ঘনত্ব (high density),
- উচ্চ স্ফুটনাঙ্ক (high boiling point) ইত্যাদি।
- অন্যদিকে এর ক্ষারকতা, অম্লতা এবং
- আঠালত্ব শূন্য হতে হতে হবে।
৬. রেডিয়েশন শিল্ড (Radiation shield):
পারমাণবিক চেইন বিক্রিয়ার ফলে যে গামারশ্মি বের হয় তা অত্যধিক তাপ উৎপন্ন করে এবং খুবই বিষাক্ত হয়। রেডিয়েশন শিল্ড এই তাপকে কমিয়ে রাখে এবং বিষাক্ততা বাইরে আসতে দেয় না। এছাড়া রিয়্যাক্টরের পাত্রের বা আধার (Container)-এর দেয়ালকে নিউট্রনের গতি, আলফা, বিটা বা গামা রশ্মিসহ ইত্যাদির প্রকোপ (outbreak) থেকে রক্ষা করার জন্য রেডিয়েশন শিল্ডকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
রেডিয়েশন শিল্ড সাধারণ ইস্পাত ধাতু দ্বারা তৈরি করা হয় এবং এর চারদিকে মােটা কংক্রিটের আস্তরণ অথবা মজবুত ইটের দেওয়াল দেওয়া থাকে। জেনে রাখা ভালো যে, কংক্রিটের তৈরি শিল্ডিং দেওয়াল দামেও সস্তা এবং সকল প্রকার বিষাক্ততা রােধ করার উপযুক্ত।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহৃত রিয়্যাক্টরঃ
রিয়্যাক্টরের প্রকৃতি বিবেচনা করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নিম্নলিখিত আট প্রকার রিয়্যাক্টর ব্যবহার করা হয়, যথাঃ
১. চাপবিশিষ্ট পানি রিয়্যাক্টর (pressurised water reactor বা P.W.R)
২. গরম পানি রিয়্যাক্টর (boiling water reactor বা B.W.R)
৩. গ্যাস শীতলকারী রিয়্যাক্টর (gas cooled reactor বা G.C.R)
৪. ফাস্ট ব্রিডার রিয়্যাক্টর (Fast breeder বা F.B.R),
৫. সােডিয়াম গ্রাফাইট রিয়্যাক্টর (sodium graphite reactor বা S.G.R)
৬. পাওয়ার রিয়্যাক্টর (power reactor)
৭. সমসত্ত্ব রিয়্যাক্টর (Homogeneous reactor) এবং
৮. শিপিং পোর্ট রিয়্যাক্টর (shipping port reactor)
তবে এসব রিয়্যাক্টরগুলোর মধ্যে সমসত্ত্ব রিয়্যাক্টর (Homogeneous reactor) এবং শিপিং পোর্ট রিয়্যাক্টর (shipping port reactor) কেন্দ্রীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের রিয়্যাক্টর হিসেবে ব্যবহার করা হয় না।
নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর সম্বন্ধে আরও জানতে নিচের ভিডিওটি দেখুনঃ
পাওয়ার প্ল্যান্ট সম্বন্ধে আরও জানতে নিচের লেখাগুলো পড়ুনঃ
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে বিবেচ্য বিষয়।
তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য উপযুক্ত এলাকা নিরবাচনে বিবেচ্য বিষয়সমুহ।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সুবিধা ও অসুবিধা।
ইউরেনিয়াম সম্বন্ধে আলোচনা।
বর্তমান বিশ্ব ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
বাষ্প বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্বন্ধে আলোচনা।
পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইতিহাস ও সংক্ষিপ্ত আলোচনা।
পাওয়ার প্ল্যান্টঃ সংজ্ঞা, প্রকারভেদ ও কার্যপদ্ধতি।