বৈদ্যুতিক মোটর কিভাবে ঘুরে? | মোটর মামার টর্ক সৃষ্টির রহস্য

বৈদ্যুতিক মোটর ঘুরতে দেখতে খুব ভাল লাগে। ছোটবেলায় খেলনা পুরানো হয়ে গেলে তার ভেতর থেকে ডিসি মোটর বের করে সেটা ঘুরানোর মধ্যে অন্য রকম এক আনন্দ কাজ করত। কিন্তু তখন হয়ত কিভাবে মোটর ঘুরছে বা কেন এমন হচ্ছে এসব নিয়ে প্রশ্ন মনে আসেনি। অবাক করা ব্যাপার হল বি এস সি বা ডিপ্লোমা পাশ করার পরেও অনেক ছাত্র-ছাত্রী বৈদ্যুতিক মোটরের টর্ক সৃষ্টির ম্যাকানিজম সম্পর্কে অবগত না বা ধারণা থাকলেও কনসেপ্ট ক্লিয়ার থাকেনা। আজ আমার এই আর্টিকেলের মূল উদ্দেশ্য হল মোটর মামার টর্ক সৃষ্টির নেপথ্যে রহস্য উদঘাটন করা।

মোটর, জেনারেটর, ট্রান্সফরমার এসমস্ত ডিভাইস মূলত ইলেকট্রোম্যাগনেটিক থিওরির উপর ভিত্তি করে বানানো হয়েছে। তাই ইলেকট্রোম্যাগনেটিজম নিয়ে আপনার ধারণা যত ক্লিয়ার থাকবে আজকের এই আর্টিকেলটি আপনার কাছে ততই সহজবোধ্য মনে হবে। গল্পে গল্পে সহজভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা থাকবে ইনশাল্লাহ।

বৈদ্যুতিক মোটর কিভাবে ঘুরে?

দন্ড চুম্বকের সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। একটি দন্ড চুম্বককে একদম স্বাধীনভাবে ঝুলিয়ে দিলে এটি সর্বদাই উত্তর-দক্ষিণ বরাবর মুখ করে থাকবে। এর কারণ হচ্ছে পৃথিবী একটি বিরাট চৌম্বকক্ষেত্র। পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের বলয়গুলো (ফ্লাস্ক) সর্বদাই উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরুর দিকে প্রবেশ করে। তাই দন্ড চুম্বক পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের সাথে একই দিক বরাবর থাকতে চায়।

এটি চুম্বকের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। একজন মানুষ যেমন তার অনুরুপ মানুষের সাথে ফ্রেন্ডশীপ করতে চায় তেমনি প্রতিটি চুম্বকই বহিঃস্থ কোন চৌম্বকক্ষেত্রের সাথে নিজেকে সমাপতিত (align) করতে চায়। এখন যদি আপনি এক্সটার্নাল ম্যাগনেটিক ফিল্ডকে স্থির না রেখে ঘোরাতে থাকেন, তবে দন্ড চুম্বকটিও সেটির সাথে সমানভাবে পতিত বা সমমুখী হবার জন্য ঘুরতে থাকবে।

একটা বাস্তব উদাহরণ দিই। বাংলায় দলকানা বলে একটা শব্দ থাকে। তার মানে নিজের বন্ধু যেদিকে যাবে, আপনিও সেদিকে যাবেন। সেটা হোক ঠিক বা ভূল পথ। এখানে ব্যাপারটিও একদম এক।

মোটর
ঘূর্ণনশীল চৌম্বকক্ষেত্র

এটিই হচ্ছে মূলত মোটর মামার ঘূর্ণন ক্রিয়ার রহস্য। তার মানে, মোটর মামা কাজ করে দুইটি চৌম্বকক্ষেত্রের ক্রিয়ার মাধ্যমে- ঘূর্ণায়মান চৌম্বকক্ষেত্র এবং স্থির চৌম্বকক্ষেত্র যা গতিশীল চৌম্বকক্ষেত্রকে অনুসরণ করে।

ঘূর্ণায়মান চৌম্বকক্ষেত্র তৈরির নেপথ্যে রহস্য

  • দন্ড চুম্বককে ঘুরিয়ে কাজটি করা যাবে। এছাড়া আরেকটি পদ্ধতি হলো তড়িৎ প্রবাহের মাধ্যমে। আপনারা ইলেকট্রোম্যাগনেটের নাম অবশ্যই শুনে থাকবেন?
  • আমরা সবাই জানি, একটি কয়েলের মধ্য দিয়ে যখন অবিরাম তড়িৎ প্রবাহিত হতে থাকে তার চারপাশে চৌম্বকক্ষেত্র বা ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড সৃষ্টি হয়।
  • সলিনয়েড নামটি নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন। যদি তারটিকে পেঁচিয়ে সলিনয়ডের আকৃতি দিয়ে এর মধ্যে একমুখী (ডিসি) কারেন্ট প্রবাহিত করলে যে চৌম্বকক্ষেত্র সৃষ্টি হবে তা চুম্বক দন্ডের চুম্বকক্ষেত্রের অনুরূপ। কারণ, ডিসি প্রবাহের জন্য কয়েল শর্ট সার্কিটের ন্যায় আচরণ করবে। যেহেতু ডিসির উঠানামা নেই তাই ফ্রিকুয়েন্সি শূন্য। তাই সেখানে কোন পরিবর্তনশীল চৌম্বকক্ষেত্র থাকবেনা। সেটি হবে একটি স্থির চৌম্বকক্ষেত্র।
  • এখন প্রশ্ন হতে পারে, কিভাবে আমি ঘূর্ণায়মান চৌম্বকক্ষেত্র সৃষ্টি করব? রোটেটিং চৌম্বকক্ষেত্র সৃষ্টি করার একটি মজাদার পদ্ধতি আছে। সেটি হচ্ছে 3-Phase সাপ্লাই ব্যবহার করা। কারণ থ্রি-ফেজ সাপ্লাইয়ে উঠানামা বা ফ্রিকুয়েন্সি অবশ্যই আছে।
  • বিদ্যুৎ সঞ্চালন এবং বিতরণ লাইনে দেখবেন তিনটি ফেজ তার থাকে। এই তিনটি লাইভ তারের মধ্য দিয়ে একই পরিমান তড়িৎ প্রবাহিত হলেও এদের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য বিদ্যমান। প্রতিটি তারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত তড়িৎ একে অপর থেকে ১২০ ডিগ্রী কোণের তফাতে রয়েছে।
  • তবে মোটর ডিজাইনে এই সামান্য পার্থক্যই বড় একটি সুবিধা এনে দিয়েছে । মোটর উইন্ডিংয়ে থ্রি-ফেজ সাপ্লাই দেয়া হলে যে লব্ধি চৌম্বকক্ষেত্র সৃষ্ট হবে তা হবে ঘূর্ণায়মান।

তাহলে এবার মাঝখানে যদি একটি চুম্বক রেখে দেওয়া হয় সেটি এই ঘূর্ণায়মান চৌম্বকক্ষেত্রকে অনুসরণ করতে থাকবে এবং ঘুরতে থাকবে। ব্যাস হয়ে গেল আমাদের মোটর। কারণ চৌম্বকক্ষেত্রের সমমেরু পরস্পরকে আকর্ষণ এবং বিপরীত মেরু পরস্পরকে বিকর্ষণ করে থাকে। এখানে স্থির এবং গতিশীল চৌম্বকক্ষেত্রকে দুজন ভাল বন্ধু হিসেবে কল্পনা করতে পারেন। যেখানে স্থির চৌম্বকক্ষেত্র তার বন্ধু গতিশীল চৌম্বকক্ষেত্রকে অনুসরণ করে চলতে চাইবে।

ইন্ডাকশন মোটর কিভাবে ঘুরবে?

উপরে এতক্ষণ যে মোটরের কথা বলা হল এই মোটরটি কিন্তু ইন্ডাকশন মোটর নয়। একে বলে Synchronous মোটর। কারণ এর ঘুরার স্পীড আমাদের ঘূর্ণায়মান চৌম্বকক্ষেত্রের স্পীডের সমান।

ইন্ডাকশন মোটরে মাঝখানে চুম্বক ব্যবহার করা হয় না। সেখানে আরেকটি তারের কুণ্ডলী ব্যবহার করা হয়। জেনারেটর তৈরির সূচনালগ্নে মাইকেল ফ্যারাডে অনেক চিন্তা করে একটি থিওরি প্রদান করেছিলেন। যা আমাদের সকলেরই জানার মধ্যে। আমরা সকলেই জানি, কোনো কুন্ডলীতে ডায়নামিক বা পরিবর্তনশীল চুম্বকক্ষেত্র চালনা করলে ঐ কুন্ডলীতে ইলেকট্রোমোটিভ ফোর্স বা ভোল্টেজ আবেশিত হয়। আর এই নীতির উপর দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় পাওয়ার জেনারেটিং প্লান্ট। একে তড়িৎ চৌম্বক আবেশ বলে। আবার আগেই বলেছি, তড়িৎবাহী কুন্ডলী নিজের একটি চুম্বকের ন্যায় আচরণ করে।

এখনো ব্যাপারটি যাদের বোধগম্য হয়নি তাদের জন্য আরেকটু সহজ করে বলি। ধরুন, আপনার কোন ফ্রেন্ড নাই। তাই আপনি নিজেই নিজের ভেতর একটি সত্তা তৈরি করে নিলেন এবং তাকেই অনুসরণ করে চলতে লাগলেন। ছোটবেলায় বাচ্চারা যেমনটা ইমাজিনারি ফ্রেন্ড তৈরি করে রাখে ঠিক তেমন।

এখানেও ব্যাপারটি তাই। আমি ঘূর্ণায়নশীল চৌম্বকক্ষেত্র দিয়ে একটি কুন্ডলীতে ই এম এফ সৃষ্টি করলাম। এবার সেই ই এম এফ দিয়ে ঐ কুন্ডলী নিজের চৌম্বকক্ষেত্র সৃষ্টি করল। এভাবে আমি তড়িৎ আবেশ বা ইন্ডাকশন প্রক্রিয়া ব্যবহার করে চুম্বককে প্রতিস্থাপন করে ঐ জায়গায় শুধু একটি কুন্ডলী স্থাপন করে ফেললাম। এই মোটরটিকে আমরা বলি ইন্ডাকশন মোটর। এবার ইন্ডাকশন মোটরের নামের নেপথ্যে রহস্য ও আমাদের কাছে ক্লিয়ার।

আরো কিছু আর্টিকেল

ডিসি মেশিনের ব্যাসিক ধারণাঃ পর্ব-১ | মোটর-জেনারেটর

ডিসি মেশিনের ব্যাসিক ধারণাঃ পর্ব-২ | মোটর-জেনারেটর

ইন্ডাকশন মোটরের কগিং কি? কেন হয়?