হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে বাঁধ। যে উচ্চতায় বাঁধ নির্মাণ করা হয় তার অনেক নিচে ওয়াটার টারবাইন, পাম্প ও পাওয়ার হাউজ স্থাপন করা হয়। কোনাে কোনাে হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্টে একাধিক বাঁধ নির্মাণ করে পতিত পানির (tail water) সাহায্যে তুলনামূলক ছােট টারবাইন ও জেনারেটর চালিয়ে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ শক্তি উৎপন্ন করা হয়।
এই লেখাতে আমরা হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্টের বাঁধ সম্বন্ধে যেসব বিষয় আলোচনা করবঃ
- বাঁধ বলতে কি বুঝায়?
- বাঁধের প্রকারভেদ।
- কংক্রিট অথবা পাথর ঢালাই বাঁধ (Concrete or stone masonry dam)
- এক ধাপ বিশিষ্ট বাঁধ (Single step design dam)
- একাধিক ধাপবিশিষ্ট বাঁধ (Multi step design dam)
- Gravity Dam (অভিকর্ষ বাঁধ)
- Buttress Dam (বাট্ট্রেস বাঁধ)
- Arch Dam (খিলানো বাঁধ)
- মাটি অথবা শিলা নির্মিত বাঁধ (Earth or rock fill dam)
- কাঠের গুঁড়ি নির্মিত বাঁধ (Timber made dam)
বাঁধ বলতে কি বুঝায়?
বাঁধ বলতে আমরা সাধারণত কোন বাঁধা বা প্রতিবন্ধকতাকে বুঝি। অন্যদিকে হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্টে বাঁধ বলতে দেয়াল স্বরূপ এমন একটি প্রতিবন্ধক বা দেয়ালকে বুঝায় যা পানির স্রোত অথবা পানির প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে পানিকে বাঁধের পিছনের অংশে বা সংশ্লিষ্ট ক্যাচমেন্ট এরিয়াতে জমাকরণে সাহায্য করে।
খরস্রোতা পাহাড়ি নদী বা সারা বছর পানির অধিক উচ্চতা বজায় থাকে এরুপ নদীতে হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করলে অবশ্যই বাঁধ নির্মাণ করতে হয়। তবে অধিক উচ্চতাবিশিষ্ট খরস্রোতা নদীর বাঁধ শক্ত ও চওড়া হওয়া আবশ্যক, অন্যথায় বন্যার সময় স্রোতের টানে বাঁধে ফাটল বা বাঁধ ভেঙ্গে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই বাঁধ পানি জমা রাখার পাশাপাশি পানির হেড বা উচ্চতাও তৈরি করে। এছাড়া বাঁধে পানির উচ্চতা বাড়ানোর জন্য ওয়াটার টারবাইনের শ্যাফট দ্বারা পরিচালিত পাম্পের সাহায্যে পতিত পানিকে (tail water) বাঁধের পানির আধারে অথবা পেনস্টকে সরবরাহ করে বাঁধের পানির উচ্চতা বাড়ানো হয়।
বাঁধের প্রকারভেদঃ
নির্মাণ প্রক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্টের বাঁধ তিন ভাগে ভাগ করা হয়, যেমনঃ
- কংক্রিট অথবা পাথর ঢালাই বাঁধ (Concrete or stone masonry dam)
- মাটি অথবা শিলা নির্মিত বাঁধ (Earth or rock fill dam)
- কাঠের গুঁড়ি নির্মিত বাঁধ (Timber made dam)
কংক্রিট অথবা পাথর ঢালাই বাঁধঃ
কংক্রিট অথবা পাথর ঢালাই বাঁধ সবচেয়ে মজবুত ও শক্ত হয় বলে আজকাল প্রায় সকল প্ল্যান্টে এ ধরনের বাঁধ ব্যবহার করা হয়। এই বাঁধ সাধারণত দু’ভাবে ঢালাই করে প্রস্তুত করা হয়। যথাঃ:
- এক ধাপ বিশিষ্ট বাঁধ (Single step design dam) এবং
- একাধিক ধাপবিশিষ্ট বাঁধ (Multi step design dam)
এক ধাপ বিশিষ্ট বাঁধ (Single step design dam):
এই বাঁধ নির্মাণের সময় সামনের উপরের দিক হতে নিচের দিকের প্রায় অর্ধেকটা সােঁজা এবং বাকি অংশ ও পিছনের অংশ কৌণিকভাবে ঢালাই করে প্রস্তুত করা হয়।
এসব বাঁধের উপরিভাগের প্রশস্ততা সাধারণত এর উচ্চতার প্রায় ১০% থেকে ১৫% পর্যন্ত হয়ে থাকে। নিচের চিত্রে কংক্রিট অথবা পাথর ঢালাইয়ে নির্মিত এক ধাপ বিশিষ্ট বাঁধ দেখানাে হলোঃ
একাধিক ধাপবিশিষ্ট বাঁধ (Multi step design dam):
এই ধরনের বাঁধের নিচের দিক চওড়া এবং উপরের দিক ক্রমশ সরু থাকে। এছাড়া এর সামনের নিচের দিকের অংশ কম ঢালু এবং পিছনের দিকে বা পতিত পানির দিকের অংশে পেনস্টক থাকার জন্য বেশি জায়গা নিয়ে ঢালু আকৃতির হয়। এই বাঁধ উপর থেকে নিচ পর্যন্ত পর পর মোট পাঁচটি জোনে (Zone) ভাগ করা হয়।
এই ধরনের বাঁধের ১ নং জোনে সাধারণত কোনােরূপ পানির চাপ থাকে না, যা বাড়তি উচ্চতা বলে বিবেচিত হয়। এছাড়া এই জোনের উভয় পাশ খাড়া থাকে।
২ নং জোনে সামনের দিকে পানির চাপ তুলনামূলকভাবে একটু বেশি থাকে এবং এরও উভয় পাশ খাড়া থাকে।
এবং ৩ নং, ৪ নং ও ৫ নং জোনে সামনের দিক অপেক্ষাকৃত কম কৌণিকভাবে হেলানাে বা বাঁকানাে থাকে। এবং এর পিছনের দিকটা কিছুটা বেশি কোণিকভাবে হেলানাে অবস্থায় ঢালাই করা হয়। আবার কোনাে কোনাে বাঁধের সামনের দিক কিছুটা খাড়া এবং পিছনের দিক কিছুটা ঢালু থাকে। এছাড়া এই বাঁধে পানির উচ্চতার মাঝামাঝি স্থানে সুইচ গেট এবং হেলানাে পেনস্টক যুক্ত করা হয়।
নির্মাণ ও ব্যবহারের তারতম্যভেদে কংক্রিট বা পাথর ঢালাই বাঁধকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা হয়, যথাঃ
- Gravity Dam (অভিকর্ষ বাঁধ)
- Buttress Dam (বাট্ট্রেস বাঁধ) এবং
- Arch Dam (খিলানো বাঁধ)
1. Gravity Dam (অভিকর্ষ বাঁধ):
পাথর বা কংক্রিটের মজবুত গাঁথুনী দ্বারা এই ধরনের বাঁধ তৈরি করা হয়। এ ধরনের বাঁধ প্রধানত পানির ওজনের চাপকে বাঁধা প্রদান করে। এছাড়া এই ধরনের বাঁধে পানির চাপ (Water pressure), বাঁধের ওজন (Weight of dam), আপ লিফট প্রেসার (Up lift pressure), আর্থ প্রেসার (Earth pressure), ভিত্তি স্থাপনের ক্রিয়া (Reaction of the foundation), ভূমিকম্পের চাপ (Earth – quake pressure), বাতাসের চাপ (Wind pressure) ও অন্যান্য বল প্রযুক্ত হয়।
2. Buttress Dam (বাট্ট্রেস বাঁধ):
এই বাঁধের উপরিভাগ সমতল এবং একাধিক স্প্যানের (span) সঙ্গে দেওয়াল ঢালাই করা থাকে। এই বাঁধ উপরের দিক থেকে নিচের দিকে ক্রমশ ঢালু করে নির্মাণ করা হয়, যার ফলে বাঁধে পানির ধাক্কা সমান্তরালে না হয়ে নিম্নমুখী হয়। যদিও এই বাঁধের সকল স্থান Gravity Dam এর মতাে কঠিন নয় তবুও প্রবল স্রোত ও পানির উচ্চ চাপ এই বাঁধের কোনাে ক্ষতি করতে পারে না। এই বাঁধ Gravity Dam এর তুলনায় স্থায়িত্ব শক্তিতে কোন অংশে কম নয়। এই ধরনের বাঁধের স্থাপন, রক্ষণাবেক্ষণ ও নিমার্ণ খরচ অনেক কম হওয়ায় এই বাঁধ বেশ জনপ্রিয়।
3. Arch Dam (খিলানো বাঁধ):
যে নদী সরু অথচ গভীর সাধারণত সেসব নদীতে Arch Dam নির্মাণ করা হয়। এই বাঁধের উপরিতল সমান্তরাল, সামনের পৃষ্ঠদেশ খাড়া ও পার্শ্বদেশ বক্রভাবে হেলানো থাকে যা দেখতে অনেকটা ধনুকের (Arch) মতো। সম্ভবত এই কারণেই এই বাঁধকে Arch Dam নামকরণ করা হয়েছে। এই বাঁধে পানির ধাক্কা ও চাপ খাড়াভাবে (Perpendicular) পড়ে যার ফলে এর মধ্য দিয়ে অতিরিক্ত পানি পড়ার কোন পথ থাকে না। তবে প্রয়োজন দেখা দিলে এর জন্য আলাদাভাবে স্পিলওয়ে তৈরি করে নিতে হয়। উপরোক্ত বাঁধ সমূহের মধ্যে এর নির্মাণ খরচ সবচেয়ে কম।
মাটি অথবা শিলা নির্মিত বাঁধ (Earth or rock fill Dam):
সাধারণত এই বাঁধ ৬০ মিটারের বেশী উঁচু এবং উভয় দিকেই ঢালু করে নির্মাণ করা হয়। এই বাঁধ খুবই প্রশস্ত করে তৈরি করা হয় অন্যথায় পানির স্রোত এবং ঢেউয়ের ধাক্কায় ভেঙ্গে যাবার সম্ভাবনা থাকে। কংক্রিট নির্মিত বাঁধ অপেক্ষা এটি প্রায় দশগুণ বেশি চওড়া করে নির্মাণ করা হয়। শিলা, নুড়ি, বালি, পাথরের গুড়া, কাদামাটি ইত্যাদি সহজলভ্য হলে যে কোন স্থানে এই ধরনের বাঁধ দেওয়া সম্ভব। এই বাঁধ ক্ষুদ্র বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য উপযোগী হলেও মাঝারি বা বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কোনভাবেই উপযোগী নয়।
এই ধরনের বাঁধ নির্মাণ খরচ অপেক্ষাকৃত কম হলেও এর মধ্য দিয়ে পানি লিক করার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া এই ধরনের বাঁধ প্রবল স্রোত সহ্য করতে পারে না। যার ফলে বর্তমানে মাটি অথবা শিলা নির্মিত বাঁধের প্রচলন খুবই কম।
কাঠের গুঁড়ি নির্মিত বাঁধ (Timber made dam):
অতীতে যেখানে কাঠের প্রাচুর্য ছিল অথচ ঢালাইকরণ দ্রব্যাদির দুষ্প্রাপ্যতা ছিল শুধুমাত্র ঐ সকল স্থানেই কাঠের গুঁড়ি দ্বারা বাঁধ নির্মাণ করা হতো। কাঠের গুঁড়ি পানির উচ্চতার পরিমাপ অনুসারে কেটে কেটে এবং খাড়া অথবা আড়াআড়িভাবে, পাশাপাশি স্থাপন করে এই ধরনের বাঁধ নির্মাণ করা হতো। কিন্তু কাঠ পঁচনশীল, দামে বেশি ও টেকসই নয় বলে বর্তমানে এসব বাঁধের প্রচলন নেই।
References:
Principles of Power system by V. K. Metha & Rohit Metha
Power Plant Engineering by Bangla Academy Dhaka
অন্যান্য লেখাসমূহঃ
পাওয়ার প্ল্যান্টঃ সংজ্ঞা, প্রকারভেদ ও কার্যপদ্ধতি।
পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইতিহাস ও সংক্ষিপ্ত আলোচনা।
হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্টের সুবিধা-অসুবিধা।
হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রকারভেদ ও বিস্তারিত আলোচনা।
হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্টের উপাদানসমূহ।