প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ পানি শক্তি বা হাইড্রো পাওয়ার ব্যবহার করে আসছে। স্টিম ইঞ্জিন আবিষ্কারের অনেক আগে বিভিন্ন দেশের মানুষ পানি প্রবাহের গতিকে কাজে লাগিয়ে চাকা ঘুরিয়ে শস্য দানা মাড়াই, ময়দা কল, কাঠ চেরাই কল ইত্যাদি চালাতো। সময়ের পরিবর্তনের সাথে পানির এই গতি শক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানুষ বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করা শুরু করে। যা হাইড্রো ইলেকট্রিসিটি হিসেবে পরিচিত।
আজকের আলোচনায় আমরা হাইড্রো ইলেকট্রিসিটি ও হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্ট সম্বন্ধে প্রাথমিক কিছু বিষয়ে ধারণা দেব।
আজকের আলোচনায় যা যা থাকছেঃ
- হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্ট সৃষ্টির ইতিহাস।
- হাইড্রো ইলেকট্রিসিটি বা পানি বিদ্যুৎ কি?
- হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্ট বা পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র কাকে বলে?
হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্ট সৃষ্টির ইতিহাসঃ
মূলত উনিশ শতকের দিকে হাইড্রো ইলেকট্রিসিটি বা পানি বিদ্যুৎ প্রযুক্তির সম্প্রসার ঘটতে থাকে। ১৮২৭ সালে ফরাসী প্রকৌশলী বেনোইট ফোরনিওরন (Benoit Fourneyron) একটি টারবাইন তৈরি করেছিলেন যা প্রায় ছয় অশ্ব ক্ষমতা (Six Horse Power) শক্তি উৎপাদন করতে সক্ষম ছিলো।
১৮৪৯ সালে ব্রিটিশ–আমেরিকান প্রকৌশলী জেমস ফ্রান্সিস (James Francis) প্রথম আধুনিক ওয়াটার টারবাইন তৈরি করেছিলেন। যা ফ্রান্সিস টারবাইন হিসেবে পরিচিত এবং এটি বর্তমান বিশ্বে সর্বাধিক ব্যবহৃত ওয়াটার টারবাইন।
১৮৭০-এর দশকে আমেরিকান উদ্ভাবক লেস্টার অ্যালান পেলটন (Lester Allan Pelton) একটি পেল্টন হুইল তৈরি করেছিলেন, যা মূলত একটি ইমপালস ওয়াটার টারবাইন ছিল। কিন্তু তিনি এটি প্রকাশ করেছিলেন ১৮৮০ সালে।
এসব টারবাইন আবিষ্কারের ফলশ্রুতিতে ১৮৮২ সালে সর্বপ্রথম আমেরিকাতে পানি শক্তি থেকে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনের উদ্দেশ্যে পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বা হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়। এরপর ধীরে ধীরে অন্যান্য দেশেও হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপিত হতে থাকে।
বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয় যা পার্বত্য চট্টগ্রামের ৫০ কিলোমিটার দূরবর্তী রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলার কর্ণফুলী নদীর উপর অবস্থিত এবং এটি বাংলাদেশের একমাত্র হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্ট। এছাড়া বাংলাদেশ সরকারের শঙ্খ ও মাতামুহুরী নদীতে হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
হাইড্রো ইলেকট্রিসিটি বা পানি বিদ্যুৎ কি?
হাইড্রো ইলেকট্রিসিটি বা পানি বিদ্যুৎ বলতে পানির শক্তিকে ব্যবহার করে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করাকে বুঝায়।
ঐতিহাসিকভাবে প্রাথমিক অবস্থায় যান্ত্রিক কলকারখানা, শস্য মাড়াই ইত্যাদিতে হাইড্রো পাওয়ার ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে আধুনিক হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো টারবাইন এবং জেনারেটর ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে থাকে যা হাইড্রো ইলেকট্রিসিটি হিসেবে পরিচিত।
হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্ট বা পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র কাকে বলে?
যে জেনেরেটিং স্টেশনে পানি শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করা হয় তাকে হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্ট বলে।
আরেকটু সহজভাবে বলতে পারি, “যে জেনেরেটিং স্টেশনে পানির প্রবাহকে টারবাইন ঘুরানোর কাজে লাগিয়ে টারবাইন শ্যাফটের সাথে কাপলিং করা বৈদ্যুতিক জেনারেটরকে ঘুরিয়ে বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপাদন করা হয় তাকে হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্ট বলা হয়।“
হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্ট সাধারণত হাইড্রো পাওয়ার প্ল্যান্ট, পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বা জল বিদ্যুৎ কেন্দ্র হিসেবেও পরিচিত।
নদীর প্রবাহিত পানিতে যে বিপুল পরিমাণ শক্তি নিহিত রয়েছে তা এমনিতে অনুমান করা কঠিন। কিন্ত এ পানি যখন একটি সরু নল বা সরু পথ দিয়ে প্রবাহিত করা হয় তখন এর শক্তির বিষটি উপলব্ধি করা যায়।
হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্টে পানির স্থৈতিক শক্তিকে প্রথমে যান্ত্রিক শক্তিতে, এরপর এই যান্ত্রিক শক্তিকে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রুপান্তরিত করা হয়।
অর্থাৎ, খরস্রোতা নদীতে বাঁধ দেবার পর বাঁধের মধ্য দিয়ে যে পানি প্রবাহিত হয় তা দ্বারা ওয়াটার টারবাইনকে ঘুরানো হয়, ওয়াটার টারবাইন তখন অল্টারনেটর বা জেনারেটরকে ঘুরিয়ে বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপন্ন করে।
হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্টে জোয়ার ভাটার শক্তি, বৃষ্টিপাত, তুষারপাত, বরফ গলা পানি, সমুদ্র তরঙ্গ প্রভৃতির পানি শক্তিকে কাজে লাগিয়েও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়ে থাকে।
References: International Hydropower Association Principles of Power system by V. K. Metha & Rohit Metha Power PlantEngineering by Bismonath Majumdar
অন্যান্য লেখাসমূহঃ
ইলেকট্রিক্যাল এনার্জির প্রাথমিক উৎসগুলো সম্বন্ধে আলোচনা।
পাওয়ার প্ল্যান্ট: সংজ্ঞা, প্রকারভেদ ও কার্যপদ্ধতি সম্বন্ধে পড়ুন।
পাওয়ার প্লান্টে টারবাইন নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্বন্ধে পড়ুন।
প্রাইম মুভারঃ সংজ্ঞা, প্রকারভেদ, ব্যাখা ও টারবাইন সম্বন্ধে আলোচনা।