একটি পাওয়ার স্টেশনের বা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের লোড কখনই স্থির থাকে না, সময়ের সাথে এটি পরিবর্তিত হতে থাকে। এই লোডের ভিন্নতা দিনের সম্পূর্ণ সময় (২৪ ঘন্টা), আধ ঘন্টা বা প্রতি ঘন্টায় রেকর্ড করা হয় এবং তা লোড কার্ভের সাহায্যে প্রকাশ করা হয়। এই লেখাতে আমরা লোড কার্ভ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
আলোচনায় যা যা থাকছেঃ
- লোড কার্ভের সংজ্ঞা।
- বিভিন্ন প্রকার লোড কার্ভঃ
- দৈনিক লােড কার্ভ।
- একক লোড কার্ভ
- সমষ্টিগত লোড কার্ভ।
- আদর্শ লোড কার্ভ।
- বাস্তব লোড কার্ভ।
- সাপ্তাহিক লােড কার্ভ।
- মাসিক লােড কার্ভ।
- বার্ষিক লােড কার্ভ।
- দৈনিক লােড কার্ভ।
- লোড কার্ভের প্রয়োজনীয়তা।
লোড কার্ভের সংজ্ঞা:
সময়ের সাথে একটি পাওয়ার স্টেশনে লোডের তারতম্য যে curve বা বক্ররেখার সাহায্যে প্রকাশ করা হয় তাকেই লোড কার্ভ (Load Curve) বলা হয়।
এছাড়া লোড কার্ভকে নিম্নোক্তভাবেও সংজ্ঞায়িত করা হয়। যেমনঃ
যে কার্ভে সর্বোচ্চ কিলােওয়াট লােডকে বাম প্রান্তের অক্ষ এবং সময়কে x অক্ষ বরাবর প্রকাশ করে কিলােওয়াটকে সময়ের সাথে গ্রাফে প্লট (Plot) করলে যে লেখচিত্র পাওয়া যায়, তাকে লােড কার্ভ বলা হয়।
সময়ের (ঘণ্টা, দৈনিক, মাসিক, বাৎসরিক) সঙ্গে সম্পর্ক রেখে বৈদ্যুতিক শক্তি সরবরাহ ও ব্যবহারের গ্রাফ চিত্রকে লােড কার্ভ বলা হয়।
বিভিন্ন প্রকার লোড কার্ভঃ
দৈনিক লােড কার্ভ (Daily load curve): মধ্যরাত ১২:০০ টা হতে পরবর্তী রাত ১২:০০ টা পর্যন্ত মােট ২৪ ঘণ্টা বা একদিনের জন্য যে লোড কার্ভ ব্যবহার করা হয় তাকে দৈনিক লােড কার্ভ বলা হয়। নিচের চিত্রে একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের দৈনিক লোড কার্ভ দেখানো হলোঃ
এই চিত্র থেকে বুঝা যায় যে, সন্ধা ৬ টায় সর্বোচ্চ এবং রাত ১২ টায় সর্বনিম্ন লোড ছিল।
সাপ্তাহিক লোড কার্ভ (Weekly load curve): এক সপ্তাহের লোড যে কার্ভ দ্বারা প্রকাশ করা হয় তাকে সাপ্তাহিক লোড কার্ভ বলা হয়।
মাসিক লোড কার্ভ (Monthly load curve): যে লোড কার্ভের সাহায্যে এক মাসের লোড প্রকাশ করা হয় তাকেই মাসিক লোড কার্ভ বলা হয়।
মাসিক লোড কার্ভ মূলত সেই মাসের দৈনিক লোড কার্ভ থেকে পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে এক মাস যাবত দিনের বিভিন্ন সময়ের পাওয়ারের গড় মানগুলো গণনা করা হয় এবং তারপর তা গ্রাফ আকারে প্রকাশ করা হয়। মাসিক লোড কার্ভ শক্তির হারগুলো স্থির করতে ব্যবহার করা হয় (to fix the rates of energy)।
বার্ষিক লোড কার্ভ (Yearly load curve): যে লোড কার্ভের সাহায্যে এক বছরের লোড প্রকাশ করা হয় সেই লোড কার্ভকে বার্ষিক লোড কার্ভ বলা হয়।
বার্ষিক লোড কার্ভটি নির্দিষ্ট বছরের মাসিক লোড কার্ভ বিবেচনা করেই তৈরি করা হয়। সাধারণত বার্ষিক লোড ফ্যাক্টর নির্ধারণ করতে বার্ষিক লোড কার্ভ ব্যবহার করা হয়।
দৈনিক লোড কার্ভের শ্রেণীবিভাগঃ
লোড কার্ভের প্রকৃতি ও ব্যবহার বিবেচনা করে দৈনিক লোড কার্ভকে সাধারণত দুইটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। যেমনঃ
১. একক লোড কার্ভ (Individual load curve) এবং
২. সমষ্টিগত লোড কার্ভ (Group load curve)
১. একক লোড কার্ভ (Individual load curve): কোন এক স্বতন্ত্র গ্রাহকের যেমনঃ আবাসিক মালিক, সংস্থা বা শিল্প প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন চাহিদার উপর নির্ভর করে প্রকৃত চাহিদা যে লোড কার্ভ দ্বারা প্রকাশ করা হয় তাকে একক লোড কার্ভ বলে।
যেমনঃ কুর্মিটোলা সেনাবাহিনী এলাকার জন্য একক লোড, আদমজী জুট মিলের জন্য একক লোড কার্ভ ইত্যাদি।
২. সমষ্টিগত লোড কার্ভ (Group load curve): যে লােড কার্ডের মাধ্যমে কোনাে একটি এলাকার গ্রাহকদের দৈনন্দিন চাহিদার উপর নির্ভর করে প্রকৃত চাহিদা যে লােড কার্ডে দেখানাে হয়, তাকেই সমষ্টিগত লােড কার্ভ বলা হয়।
সমষ্টিগত লোড কার্ভ আবার দুই প্রকারঃ
(ক) আদর্শ লোড কার্ভ (Ideal load curve) এবং
(খ) বাস্তব লোড কার্ভ (Actual load curve)
(ক) আদর্শ লোড কার্ভ (Ideal load curve):
এটি এমন এক প্রকার তাত্ত্বিক লােড কার্ভ, যার মাধ্যমে দিনরাত্রে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গ্রাহকদের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বা অপরিবর্তিত বিদ্যুৎ শক্তি সরবরাহ করে চাহিদা মেটানো হয়।
যেহেতু সমষ্টিগত বিদ্যুৎ চাহিদাতে সকল সময়ে একইহারে বিদ্যুতের চাহিদা থাকে না সেহেতু এই লোড কার্ভকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ব্যবহার করা হয়। তবে আদর্শ লোড কার্ভের ব্যবহার খুবই সীমিত। নিচে একটি আদর্শ লোড কার্ভ দেখানো হলোঃ
(খ) বাস্তব লোড কার্ভ (Actual load curve):
এই লােড কার্ভে দিন রাত্রের যে কোনাে সময়ে কোনাে আবাসিক, বাণিজ্যিক অথবা শিল্পকারখানা হতে গ্রাহকদের চাহিদামতো ব্যবহারিক, প্রকৃত বা পরিবর্তিত বিদ্যুতের পরিমাণ দেখানো হয়।
সাধারণ গ্রাহকদের জন্য বাস্তব লোড কার্ভ ব্যপকভাবে ব্যবহার করা হয়। নিচের চিত্রে একটি বাস্তব লােড কার্ভ দেখানো হলোঃ
দিনে রাতের বিভিন্ন সময়ে আবাসিক, বাণিজ্যিক এবং শিল্পকারখানার বিদ্যুৎ ব্যবহার অবশ্যই ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। তাই এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ চাহিদার মাত্রাও সময়ে সময়ে কমবেশি হয়। এই জন্য এই কার্ভে পরিবর্তিত চাহিদা বক্ররেখার মাধ্যমে দেখানো হয়েছে।
মূলত আবাসিক, বাণিজ্যিক ও অধিকাংশ ছােট শিল্পপ্রতিষ্ঠানে মধ্যরাত থেকে সকাল ৬.০০টা পর্যন্ত স্বাভাবিক কাজকর্ম বন্ধ থাকে, সেজন্য তখন বিদ্যুতের চাহিদাও কম থাকে। আবার সকাল ৬.০০ টার পর সকল প্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু হবার সাথে সাথে বিদ্যুতের চাহিদার মাত্রাও বাড়তে থাকে।
বেলা ১২.০০ টা বা দুপরের দিকে ক্ষেত্রবিশেষে কাজের বিরতি হয় বলে চাহিদা একটু কমে যায়। এরপর চাহিদা বাড়তে বাড়তে থাকে সন্ধ্যা ৬.০০ টার দিকে পুরোদমে কাজ চলে বলে বিদ্যুতের চাহিদাও অনেক বেশি বেড়ে যায়। ফলে, ঐ সময়কে সর্বোচ্চ চাহিদার ঘণ্টা (peak hour) এবং সর্বোচ্চ চাহিদাকে পিক লােড (Peak load) বলে।
এরপর সন্ধ্যা ৬.০০ টার পরে স্বাভাবিক কাজকর্মের কিছু বিরতি হয়। ছােট শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যায় এবং রাত ৮.০০ টার পরে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজকর্মও বন্ধ হতে থাকে বলে তখন থেকে বিদ্যুতের চাহিদা ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। সেজন্য বাস্তব লােড কার্ভের পরিবর্তিত চাহিদার ভিত্তিতে বক্ররেখার মাধ্যমে বাস্তব লােড বা বৈদ্যুতিক লোডের চাহিদা দেখানো হয়েছে।
লোড কার্ভের প্রয়োজনীয়তাঃ
নিম্নলিখিত কারণে লােড কার্ভের প্রয়ােজনীয়তা অপরিসীমঃ
১। লোড কার্ভ হতে দিনের বিভিন্ন সময়ে বিদ্যুতের বিভিন্নতা দেখা যায়।
২। এটি হতে দৈনিক, মাসিক ও বাৎসরিক সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন চাহিদার পরিমাণ জানা যায়।
৩। এটি হতে কোনো প্রকল্প লাভজনকভাবে কাজ করছে কি না তা জানা যায়।
৪। এটি বিদ্যুৎ প্রকল্পের আকার ও সংখ্যা নির্বাচন করতে সহায়তা করে।
৫। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, কোন ইউনিট কখন চালাতে হবে এবং কখন বন্ধ করতে হবে।
৬। লােভ কার্ড হতে লােড ফ্যাক্টর নির্ণয় করা যায়।
৭। লোড কার্ভ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অপারেশন শিডিউল তৈরি করতে সাহায্য করে।