হাইড্রোইলেকট্রিক / পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের এলাকা নির্বাচনে বিবেচ্য বিষয় সমূহ

হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্ট বা জল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করার জন্য উপযুক্ত স্থান নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই পাওয়ার প্ল্যান্টের স্থান নির্বাচন করার ক্ষেত্রে অনেক পরিক্ষা নিরিক্ষা করে প্রাথমিক ও চুড়ান্তভাবে স্থান জরীপ করতে হয়। একটি হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্টের স্থান নির্বাচন করার ক্ষেত্রে যে সকল বিষয় বিবেচনা করতে হয় তা নিম্নে উল্লেখ হলোঃ

  • পানির প্রাচুর্য।
  • পানি স্টোরেজের ব্যবস্থা।
  • মাটির কঠিনতা।
  • পানির উচ্চ হেড।
  • ক্যাচমেন্ট এলাকা।
  • লোড সেন্টার।
  • খুচরা যন্ত্রাংশ সংগ্রহের সুবিধা
  • যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বাজারের সুবিধা।
  • নিরাপত্তা।

পানির প্রাচুর্যঃ

যেহেতু হাইড্রোইলেক্ট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্টের মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে পানি। সেহেতু এই পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করার জন্য প্রথমেই এমন এলাকা বাছাই করা প্রয়োজন যেখানে সারা বছরই পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি থাকে। সেক্ষেত্রে অধিক বৃষ্টিপাত অঞ্চলখরস্রোতা নদী রয়েছে এমন স্থান বাছাই করা উচিত।

খরস্রোতা পাহাড়ি নদী।

অধিক বৃষ্টিপাতযুক্ত পাহাড়ি অঞ্চলঃ সাধারণত পাহাড়ি অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হওয়ায় এসব অঞ্চলের নদীগুলোতে প্রায় সারা বছরই পানি থাকে। আবার যেহেতু এসব অঞ্চলের নদীর স্রোতও অনেক প্রবল হয় সেহেতু নদীতে পানির উচ্চতা অনেক বেশি থাকে তবে শুধু শীত মৌসুমে পানির উচ্চতা কিছুটা কমে যায়। অতএব পাহাড়ি অঞ্চলের নদীতে বাঁধ দিয়ে হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করা অনেক বেশি যুক্তিসঙ্গত।

খরস্রোতা নদীঃ যেহেতু পানির উচ্চতা কম থাকলে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ওয়াটার টারবাইন এবং বৈদ্যুতিক জেনারেটর চালানো যায় না সেহেতু যে নদী খরস্রোতা বা সারা বছরই স্রোত থাকে ও পানি তুলনামূলকভাবে উচ্চ স্থান থেকে নিম্ন স্থানের দিকে ধাবিত হয় সেসব নদীতে হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্লান্ট স্থাপন করা উচিত। এর কারণ যদি পানিতে যথেষ্ট পরিমাণ স্রোত না থাকে তাহলে খরা মৌসুমে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবার আশংকা রয়েছে যা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ক্ষতিকর।

পানি স্টোরেজের ব্যবস্থাঃ

হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্টের স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে আরেকটি লক্ষনীয় দিক হচ্ছে পানি স্টোরেজ এর ব্যবস্থা আছে কি না তা নিশ্চিতকরণ। শীত বা যে সময় পানির প্রবাহ কম থাকে সে সময় যাতে প্ল্যান্টে পানি প্রবাহের কোন ঘাটতি না হয় সেজন্য প্ল্যান্টের স্থান নির্বাচনের সময় নদীর পানি বা বৃষ্টিপাতের ফলে জমাকৃত পানিকে স্টোরেজ করে রাখার জন্য বিস্তৃত জলাশয় রয়েছে এমন স্থান বাছাই করা জরুরি। অন্যথায় শীত বা খরা মৌসুমে যখন পানির উপযুক্ত প্রবাহ থাকবেনা তখন পানির উপযুক্ত প্রবাহের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

মাটির কঠিনতাঃ

হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্টের বাঁধ, স্পিলওয়ে, পেনস্টক, পাওয়ার হাউস, পাম্প হাউস, ওয়াটার টারবাইন ইত্যাদি স্থাপন করার জন্য মাটি অবশ্যই শক্ত হওয়া প্রয়োজন। এর কারণ হচ্ছে যদি হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্ট নরম মাটির উপর স্থাপন করা হয় তাহলে প্ল্যান্টে যখন একটু বেশি ক্ষমতা সম্পন্ন কয়েকটি ইউনিট একসাথে চলতে থাকবে তখন বাঁধ ও পাওয়ার হাউজে যে কম্পনের সৃষ্টি হবে তাতে পাওয়ার প্ল্যান্ট আনুষাঙ্গিক যন্ত্রপাতিসহ ভেঙে যেতে পারে বা নিচের দিকে ধ্বঁসে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া মাটির কঠিনতা না থাকলে বর্ষা মৌসুমে যখন বাঁধের পানি অস্বাভাবিক মাত্রায় বৃদ্ধি পেতে থাকে তখন সম্পূর্ণ প্ল্যান্টটি মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হতে পারে।

পানির উচ্চ হেডঃ

হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করার জন্য এমন স্থান বাছাই করা উচিত যেখানে বাঁধ দেবার পর পানির উচ্চ হেড পাওয়া যায়। মূলত ভূমি থেকে পানির উচ্চতা 50 মিটারের বেশি হলে তা উচ্চ হেড হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে বৃহৎ পরিসরের হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্টের ক্ষেত্রে 300 মিটারের বেশি উচ্চতাকে উচ্চ হেড হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

ক্যাচমেন্ট এলাকাঃ

হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্ট বা পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাঁধের পিছনে যে বিশাল এলাকায় পানি সংগ্রহ করে রাখা হয় সেই এলাকা কে ক্যাচমেন্ট এলাকা বলা হয়। যে সমস্ত এলাকা থেকে পানি রিজার্ভারে এসে জমা হয় সেই সমস্ত এলাকাকেও ক্যাচমেন্ট এলাকা বলা হয়ে থাকে। তাই এই সমস্ত পাওয়ার প্ল্যান্ট এমন স্থানে স্থাপন করতে হবে যেনো ক্যাচমেন্ট এলাকার পানি রিজার্ভারে এসে জমা হবার ব্যবস্থা থাকে। সাধারণত ক্যাচমেন্ট এলাকা হিসেবে পাহাড়ি এলাকা সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত।

ক্যাচমেন্ট এলাকা

লোড সেন্টারঃ

পাওয়ার প্ল্যান্টের স্থান লোড সেন্টারের কাছাকাছি হলে বিদ্যুৎ শক্তির পরিবহন, পরিচালন ও সরবরাহ ক্ষেত্র খরচ অনেক কম হয়। তাই যতদূর সম্ভব লোড সেন্টারের কাছাকাছি হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করা উচিত।

খুচরা যন্ত্রাংশ সংগ্রহের সুবিধাঃ

হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্টের যন্ত্রপাতি হঠাৎ করে নষ্ট হয়ে গেলে তা জরুরি ভিত্তিতে সংগ্রহ বা মেরামত করার সুবিধা রয়েছে এরুপ এলাকা বাছাই করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বাজারের সুবিধাঃ

প্ল্যান্টের খুচরা যন্ত্রাংশ আনা নেওয়া এবং প্ল্যান্টে অবস্থানরত কর্মচারী, শ্রমিকদের আসা যাওয়া, মাল পত্র আনা, তথ্য আদান প্রদান প্রভৃতি কাজের জন্য  প্ল্যান্টের কাছাকাছি নৌ পথ, সড়ক পথ এবং আকাশ পথের সুবিধা থাকা আবশ্যক।

এছাড়া কাছাকাছি বাজার থাকলে প্ল্যান্টে অবস্থানরত কর্মচারী, শ্রমিকদরা তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সহজেই সংগ্রহ করতে পারে, যা সুষ্ঠভাবে প্ল্যান্ট চালাতে সহায়ক।

নিরাপত্তাঃ

প্ল্যান্টে কর্তব্যরত কর্মচারী ও শ্রমিকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক।

এছাড়া হাইড্রোইলেক্ট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করার ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক অবস্থা, স্বল্প মূল্যে জমি ক্রয়, জরুরি মুহূর্তে রাষ্ট্রীয় সাহায্য পাবার সম্ভাবনা ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া আবশ্যক।

References:
Principles of Power system by V. K. Metha & Rohit Metha

অন্যান্য লেখাসমূহঃ
পাওয়ার প্ল্যান্টঃ সংজ্ঞা, প্রকারভেদ ও কার্যপদ্ধতি
পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইতিহাস ও সংক্ষিপ্ত আলোচনা
হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্টের সুবিধা-অসুবিধা
হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রকারভেদ ও বিস্তারিত আলোচনা