একটি হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্টের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কম্পোনেন্ট বা উপাদান হচ্ছে সার্জ ট্যাংক। সার্জ ট্যাংক মূলত স্টোরেজ ট্যাংক এর মতো এক ধরনের জলাধার। যেখানে পানি জমা করে রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। পাহাড়ি এলাকায় বড় ধরনের জলাশয় থাকলে সেখানে পাহাড় কেটে অথবা ছিদ্র করে অধিক ক্ষমতা সম্পন্ন বাঁধ নির্মাণ করার পর তাতে সার্জ ট্যাংক ব্যবহার করা হয়।
আজকের আলোচনায় সার্জ ট্যাংক সম্বন্ধে যা যা থাকছেঃ
- প্ল্যান্টে সার্জ ট্যাংকের অবস্থান।
- সার্জ ট্যাংক স্থাপনের কারণ।
- সার্জ ট্যাংক এর কার্যপ্রণালি।
- সার্জ ট্যাংক এর প্রকারভেদ।
- সাধারণ সার্জ ট্যাংক (Simple surge tank)
- রেস্ট্রিকট্রেড অরিফিস্ সার্জ ট্যাংক (Restricted orifice surge tank)
- ডিফারেনশিয়াল সার্জ ট্যাংক (Differential surge tank)
- গ্যালারী সার্জ ট্যাংক (Gallery Surge Tanks)
- ইনক্লাইনড সার্জ ট্যাংক (Inclined Surge Tanks)
প্ল্যান্টে সার্জ ট্যাংকের অবস্থান:
সার্জ ট্যাংক ব্যবহারের সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে এটি উপযুক্ত স্থানে স্থাপন করা খুবই জরুরি। বিভিন্ন ধরনের হাইড্রো-ইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্টে মূলত নিম্নোক্ত স্থান সমূহে সার্জ ট্যাংক স্থাপন করা হয়ে থাকেঃ
১. পেনস্টকের দৈর্ঘ্য কমাতে পাওয়ার হাউজের কাছাকাছি স্থানে সার্জ ট্যাংক স্থাপন করা হয়।
২. টানেল ও ভালভ হাউজের মাঝামাঝি স্থানে সার্জ ট্যাংক স্থাপন করা হয়।
৩. পেনস্টক লাইনের নিচের দিকে এবং টারবাইনের সামনের দিকের অংশেও সার্জ ট্যাংক স্থাপন করা হয়ে থাকে।
৪. এছাড়া কোনো কোনো প্ল্যান্টে এটি flat sloped conduit এবং steep sloped পেনস্টকের সংযোগ স্থলেও স্থাপন করা হয়ে থাকে।
তবে সার্জ ট্যাংকের উচ্চতা কতটুকু হবে এই বিষয়ে ধরা বাঁধা কোন নিয়ম কানুন নেই।
সার্জ ট্যাংক স্থাপনের কারণ:
সার্জ ট্যাংক স্থাপনের কয়েকটি কারণ রয়েছে। যেমনঃ
১. এটি ওয়াটার টারবাইন ও মুক্ত পানির তলের মধ্যে দুরত্ব কমিয়ে পেনস্টকে পানির আঘাতকে (Water hammering) প্রতিরোধ করে, যার ফলে পানির লাইন ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ ক্ষয় ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায়।
২. এটি ওয়াটার টারবাইনে পানির সঠিক প্রবাহ ও সঠিক উচ্চতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
৩. এছাড়া এটি টানেলে প্রবাহিত পানির উচ্চ চাপকে নিয়ন্ত্রণে রাখতেও সাহায্য করে।
সার্জ ট্যাংক এর কার্যপ্রণালী:
যখন টারবাইনের লােড কমে যায় তখন এর সাথে সংযুক্ত থাকা গভার্নরের (Governor) মাধ্যমে টারবাইনের গেট (Gate) আংশিক বন্ধ হয় যায়। গেট বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে টারবাইনে পানির প্রবাহ বিপরীতমুখী হয়, তখন লাইনে থাকা অতিরিক্ত পানি স্টোরেজ হিসাবে সার্জ ট্যাংকে এসে জমা হয়।
আবার যখন হঠাৎ টারবাইনে লােড বৃদ্ধি পেয়ে গভর্নরের সাহায্যে গেট খুলে যায়, তখন সার্জ ট্যাংকে জমাকৃত পানির সাহায্যে অতিরিক্ত পানির প্রয়োজনীয়তা মিটানাে হয়।
কাজেই এই সার্জ ট্যাংক যেমন একাধারে টারবাইনের লােড হ্রাস ও বৃদ্ধির ক্ষেত্রে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে তেমনিভাবে পেনস্টককে পানির হ্যামারিং (Hammering) ইফেক্ট থেকেও দূর করে রাখে।
সার্জ ট্যাংক এর প্রকারভেদ:
সার্জ ট্যাংকের গঠনগত দিক থেকে সার্জ ট্যাংককে প্রধান ৫ টি ভাগে ভাগ করা যা, যেমনঃ
(ক) সাধারণ সার্জ ট্যাংক (Simple surge tank)
(খ) রেস্ট্রিকট্রেড অরিফিস্ সার্জ ট্যাংক (Restricted orifice surge tank)
(গ) ডিফারেনশিয়াল সার্জ ট্যাংক (Differential surge tank)
(ঘ) গ্যালারী সার্জ ট্যাংক (Gallery Surge Tanks)
(ঙ) ইনক্লাইনড সার্জ ট্যাংক (Inclined Surge Tanks)
উক্ত সার্জ ট্যাংক সমূহ চিত্র সহকারে নিচে বর্ণনা করা হলাে-
(ক) সাধারণ সার্জ ট্যাংক (Simple Surge Tank):
সাধারণ সার্জ ট্যাংক দেখতে অনেকটা vertical pipe এর মতো। এটি পেনস্টক ও ওয়াটার টারবাইনের মাঝামাঝি স্থানে সরলভাবে সংযুক্ত থাকে। যখন হঠাৎ করে পানির প্রবাহ বেড়ে যায় তখন সার্জ ট্যাংক ঐ পানি তার আধারে জমা করে রাখে এবং পানির অতিরিক্ত চাপকে প্রতিরোধ করে (neutralize)।
এই সার্জ ট্যাংকগুলো সাধারণত অনেক উচ্চতায় স্থাপন করা হয় যাতে সম্পূর্ণ লোড অবস্থায় পানি ওভার ফ্লো (over flow) হতে না পারে।
খ) রেস্ট্রিকট্রেড অরিফিস্ সার্জ ট্যাংক (Restricted orifice surge tank):
এই ধরনের সার্জ ট্যাংকে পেনস্টক ও ট্যাংকের মধ্যে একটি রেস্ট্রিকটেড অরিফিস (orifice) থাকে। এই অরিফিসকে থ্রোটল বা শ্বাসনালী (throttle) বলে। যার কারণে রেস্ট্রিকটেড অরিফিস সার্জ ট্যাংককে থ্রোটল সার্জ ট্যাংকও বলা হয়। এই থ্রোটল বা অরফিসের ব্যাস খুব কম। তবে এই ধরনের ট্যাংক সাধারণ ট্যাংকের চেয়ে অনেক দক্ষতাপূর্ণ এবং সাধারণ ট্যাংকের তুলনায় এর নির্মাণ খরচও অনেক কম।
(গ) ডিফারেনশিয়াল সার্জ ট্যাংক (Differential surge tank):
গঠনগত দিক থেকে সাধারণ সার্জ ট্যাংক ও রেস্ট্রিকটেড অরিফিস সার্জ ট্যাংক এর সমন্বিত গঠনে এটি সৃষ্টি করা হয়েছে। এই ট্যাংকে একটি ছোট ছিদ্র বিশিষ্ট রাইজার পাইপ থাকে। যখন পেনস্টকে অতিরিক্ত চাপে পানি প্রবাহিত হয় তখন এই রাইজারের মাধ্যমে পানি ট্যাংকে প্রবেশ করে। আবার যখন পানির অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয় তখন এই অতিরিক্ত চাপটি সার্জ ট্যাংকের অভ্যন্তরীণ রাইজার দ্বারা ধ্বংস হয় এবং ট্যাংকে পানি জমা হয়। রাইজারের নীচের প্রান্তে কিছু এ্যানুলার পোর্ট রয়েছে। এই পোর্টগুলো ট্যাংকের ভিতরে বা বাইরে পানির অতিরিক্ত প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে।
(ঘ) গ্যালারী সার্জ ট্যাংক (Gallery Surge Tanks):
এই ধরণের সার্জ ট্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত একটি স্টোরেজ গ্যালারী তৈরি করা থাকে। যা সাধারণত সার্জ ট্যাংকের উপরের স্তরে বা নীচের স্তরে নির্মাণ করা থাকে।
গ্যালারি সার্জ ট্যাংকে উপরে নির্মিত গ্যালারীগুলো অতিরিক্ত চাপ শোষণ করতে ব্যবহার করা হয় এবং নীচে নির্মিত গ্যালারীগুলো অতিরিক্ত পানি সঞ্চয় করতে ও প্রয়োজনের সময় ছেড়ে দিতে ব্যবহার করা হয়।
সার্জ ট্যাংকের এই অতিরিক্ত স্টোরেজ গ্যালারীগুলোর উপরের গ্যালারিকে এক্সপেনশন চেম্বার (Expansion Chamber) বা Upper Gallery এবং নিচের গ্যালারিকে Lower Gallery বলা হয়ে থাকে।
(ঙ) ইনক্লাইনড সার্জ ট্যাংক (Inclined Surge Tank):
এই ধরণের সার্জ ট্যাংক কিছুটা বাঁকা করে নির্মাণ করা হয়। অন্যান্য সার্জ ট্যাংকের তুলনায় এর নির্মাণ ব্যয় বেশি এবং স্থাপন করতেও বেশি জায়গার প্রয়োজন হয়। বর্তমানে হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্টে এই ধরনের ট্যাংকের ব্যবহার নেই বললেই চলে।
হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্ট সম্বন্ধে অন্যান্য লেখাসমূহঃ
হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্টের পানির উচ্চতা নিয়ন্ত্রণ গেট সম্বন্ধে আলোচনা।
হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্টের স্পিলওয়ে সম্বন্ধে আলোচনা।
পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাঁধ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা।
পাওয়ার প্ল্যান্টঃ সংজ্ঞা, প্রকারভেদ ও কার্যপদ্ধতি।
পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইতিহাস ও সংক্ষিপ্ত আলোচনা।
হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্টের সুবিধা-অসুবিধা।
হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রকারভেদ ও বিস্তারিত আলোচনা।
হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্টের উপাদানসমূহ।