একটি পাওয়ার প্ল্যান্ট বা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের প্রধান ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র হচ্ছে প্রাইম মুভার। আজকে আমরা এই প্রাইম মুভার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
“পাওয়ার প্ল্যান্টে সংজ্ঞা, প্রকারভেদ ও কার্যপদ্ধতি সম্বন্ধে পড়ুন”
আজকের আলোচনায় যা যা থাকছেঃ
- প্রাইম মুভার কি?
- প্রাইম মুভারের শ্রেণি বিন্যাস।
- ডিজেল ইঞ্জিন (Diesel Engine) প্রাইম মুভার।
- বাষ্প টারবাইন (Steam Turbine) প্রাইম মুভার।
- গ্যাস টারবাইন (Gas Turbine) প্রাইম মুভার।
- পানি টারবাইন (Water Turbine) প্রাইম মুভার।
প্রাইম মুভার কি?
প্রাইম মুভার এমন এক ধরনের মেশিন যার সাহায্যে যান্ত্রিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপন্ন করা হয় আর এই বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করার জন্য একটি চুম্বক-ক্ষেত্র এবং একটি আর্মেচার যার উপরি ভাগে তারের কয়েল প্যাঁচানো থাকে যাকে যান্ত্রিক শক্তির মাধ্যমে চুম্বক ক্ষেত্রে ঘুরানো হয়। আর যে যন্ত্রের মাধ্যমে একে ঘুরানো হয় তাকেই প্রাইম মুভার বলা হয়। যেমনঃ টারবাইন।
প্রাইম মুভার মূলত নিজে ঘুরে এবং অপরকে শক্তি উৎপন্ন করতে সাহায্য করে। শুধু নিজে ঘুরলে এবং অপরকে শক্তি উৎপাদনে সাহায্য করলেই তাকে প্রাইম মুভার বলা যাবে না কারণ প্রাইম মুভারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রাইম মুভার প্রাকৃতিক শক্তি হতে যান্ত্রিক শক্তি প্রাপ্ত হয়। যেমনঃ বাষ্প টারবাইন, গ্যাস টারবাইন, পানি টারবাইন, অন্তর্দাহ ও বহির্দাহ ইঞ্জিন ইত্যাদি।
সাধারনট একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে প্রাইম মুভার এসি জেনারেটরের শ্যাফটকে ঘুরিয়ে থাকে।
অন্যদিকে একটি বৈদ্যুতিক মোটর যদিও বিভিন্ন পাম্প, লেদ মেশিন, বোরিং বার ইত্যাদিকে ঘুরিয়ে থাকে কিন্তু তা প্রাইম মুভার নয় কারণ এতে প্রাকৃতিক শক্তির পরিবর্তে জেনারেটরে উৎপাদিত বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহার করা হয়।
প্রাইম মুভারের শ্রেণি বিন্যাসঃ
প্রাইম মুভারকে প্রধান দুইটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ
- তাপীয় প্রাইম মুভার
- হাইড্রোলিক প্রাইম মুভার
১. তাপীয় প্রাইম মুভার দুই ভাগে বিভক্ত:
(ক) বহির্দাহ ইঞ্জিন
(খ) অন্তর্দাহ ইঞ্জিন
(ক) বহির্দাহ ইঞ্জিন এর রয়েছে দুইটি ভাগঃ
- রেসিপ্রোকেটিং ইঞ্জিন
- টারবাইন
2. টারবাইন আবার তিন ভাগে বিভক্ত:
- বাষ্প টারবাইন
- গরম বাতাস টারবাইন
- গ্যাস টারবাইন
(খ) অন্তর্দাহ ইঞ্জিনও দুই ভাগে বিভক্ত:
- রেসিপ্রোকেটিং ইঞ্জিন
- জেট ইঞ্জিন
রেসিপ্রোকেটিং ইঞ্জিন দুই ভাগে বিভক্ত :
- দুই স্ট্রোক ইঞ্জিন
- চার স্ট্রোক ইঞ্জিন
উভয় স্ট্রোক আবার ৩ ভাগে বিভক্তঃ
- গ্যাস ইঞ্জিন
- পেট্রোল ইঞ্জিন
- ডিজেল ইঞ্জিন
২. হাইড্রোলিক প্রাইম মুভার দুই ভাগে বিভক্তঃ
ক. পানি চক্র
খ. পানি টারবাইন
আমরা প্রাইম মুভারের শ্রেণি বিন্যাসকে নিম্নোক্তভাবে সাজাতে পারিঃ
প্রাকৃতিক শক্তির উৎসের প্রাচুর্যের তারতম্য অনুসারে বাংলাদেশে উৎপাদন কাজে ডিজেল ইঞ্জিন (Diesel Engine) প্রাইম মুভার, বাষ্প টারবাইন (Steam Turbine) প্রাইম মুভার, গ্যাস টারবাইন (Gas Turbine) প্রাইম মুভার ও পানি টারবাইন (Water Turbine) প্রাইম মুভার শক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।
নিচে এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলোঃ
(ক) ডিজেল ইঞ্জিন (Diesel Engine) প্রাইম মুভার:
ডিজেল ইঞ্জিন প্রাইম মুভারে জ্বালানি হিসেবে ডিজেল নামক তরল জ্বালানি ব্যবহার করা হয়। এই প্রাইম মুভার অন্তর্দাহ ইঞ্জিন (Internal Combustion Engine) এর আওতাভুক্ত। অন্তর্দাহ ইঞ্জিন বলতে যা সিলিন্ডারের মধ্যে জ্বালানি ও সঙ্কোচিত বাতাসের মিশ্রণ এর দহন ঘটানোকে বুঝায়। পেট্রোল, কেরোসিন, গ্যাস এবং ডুয়েল ফুয়েল (Duel Fuel) ইঞ্জিনও ডিজেল ইঞ্জিন প্রাইম মুভারের আওতাভুক্ত। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে অন্তর্দাহ ইঞ্জিন বলতে ডিজেল ইঞ্জিনকেই বুঝায়।
বাষ্পীয় ইঞ্জিনকেও বহির্দাহ ইঞ্জিন বলা হয়, কারণ যে বাষ্পের শক্তিতে বাষ্প-ইঞ্জিন চালিত হয় সেই বাষ্প উৎপন্ন করতে চুল্লীতে আগুনের তাপে বয়লারের ভিতরের পানি বাষ্পে পরিণত হয়, অর্থাৎ এখানে বহিরাগত তাপে বাষ্প উৎপন্ন হয়। তবে শক্তি উৎপাদন কাজে সচরাচর বাষ্পীয় ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয় না।
বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই এক বা একাধিক ডিজেল ইঞ্জিন প্রাইম মুভার চালিত পাওয়ার প্ল্যান্ট রয়েছে। এর মধ্যে ঠাকুরগাও, সৈয়দপুর, বগুড়া, ভোলা, রাজশাহী প্রভৃতি ডিজেল ইঞ্জিন পাওয়ার প্ল্যান্টের নাম উল্লেখযোগ্য। সাধারণত দুই স্ট্রোক অথবা চার স্ট্রোক এবং একাধিক সিলিন্ডার বিশিষ্ট ডিজেল ইঞ্জিনকে পাওয়ার প্ল্যান্টের প্রাইম মুভার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
(খ) বাষ্প টারবাইন (Steam Turbine) প্রাইম মুভার:
তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র অথবা পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন কেন্দ্রে পানিকে বাষ্প টারবাইন (Steam Turbine) প্রাইম মুভার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পানিকে বাষ্পে পরিণত করতে চুল্লী (Furnace), বয়লার এবং কিছু আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয়। তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জ্বালানি হিসাবে কয়লা, হাই স্পিড ডিজেল, প্রাকৃতিক গ্যাস ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়।
বাংলাদেশের আশুগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ, গোয়ালপাড়া, প্রভৃতি স্থানে বাষ্প টারবাইনকে প্রাইম মুভার হিসেবে ব্যবহার করে উচ্চ হারে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
অপর দিকে, পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে পানিকে বাষ্পে পরিণত করতে পারমাণবিক চুল্লী (Reactor), তাপ বিনিময়কারী (Heat Exchanger) যন্ত্র বা বয়লার এবং কিছু আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয়।
পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন কেন্দ্রে ইউরেনিয়াম ২৩৫ কে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র হিসাবে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিশেষভাবে পরিচিত।
রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে পারমাণবিক জ্বালানি ব্যবহার করে বাষ্প টারবাইন (Steam Turbine) এর মাধ্যমে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে।
(গ) গ্যাস টারবাইন (Gas Turbine) প্রাইম মুভার:
গ্যাস টারবাইন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে গ্যাস টারবাইনকে প্রাইম মুভার হিসাবে ব্যবহার করা হয়। সঙ্কোচিত বাতাস (Compressed Air) ও জ্বালানি দহন প্রকোষ্ঠে (Combustion Chamber’এ) দহন ঘটিয়ে বিস্ফোরক গ্যাস উৎপন্ন করে এবং সেই বিস্ফোরক গ্যাসের সাহায্যে গ্যাস টারবাইন ঘূর্ণন গতি প্রাপ্ত হয়ে ঘুরতে থাকে।
গ্যাস টারবাইন প্রাইম মুভারে জ্বালানি হিসাবে ক্রুড অয়েল, ন্যাপথা, প্রাকৃতিক গ্যাস ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়।
ন্যাপথা হচ্ছে এক ধরণের প্রাকৃতিক জ্বালানি। পেট্রোলিয়ামে শতকরা ১০ ভাগ ন্যাপথা থাকে । ১০ ভাগ ন্যাপথার হাইড্রোকার্বনে ৭ থেকে ১৪ পর্যন্ত কার্বন সংখ্যা থাকে।
বাংলাদেশের ভেড়ামারা, শাহজীবাজার, গোয়াল পাড়া, বরিশালসহ কয়েকটি গ্যাস টারবাইন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে গ্যাস টারবাইনকে প্রাইম মুভার হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
(ঘ) পানি টারবাইন (Water Turbine) প্রাইম মুভার:
পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পে পানি টারবাইনকে প্রাইম মুভার হিসাবে ব্যবহার করা হয়। খরস্রোতা নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে পানি শক্তির ধাক্কায় পানি টারবাইন ঘূর্ণন গতি প্রাপ্ত হয়ে ঘুরতে থাকে।
বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার কাপ্তাই কর্ণফুলী নদীর উপর একটি পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পে পানি টারবাইনকে প্রাইম মুভার হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
উপরে উল্লেখিত প্রাইম মুভারের মধ্যে ডিজেল ইঞ্জিন প্রাইম মুভার হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম প্রাইম মুভার বা Best Prime Mover.
কেনো সর্বোত্তম প্রাইম মুভার তা জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুনঃ
“টারবাইন সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত ধারণা “
“সর্বোত্তম প্রাইম মুভার : ডিজেল ইঞ্জিন প্রাইম মুভার“
” ব্যবহারিক কাজে জেনারেটর ও ইঞ্জিন সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন – উত্তর পড়ূন “
References:
Power Plant Engineering – Bisbonath Majumdar
Science Direct